বৈশ্বিক মন্দায় অস্তিত্ব সংকটে মধ্যবিত্ত

গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মধ্যবিত্তরা অধিকতর ভালো শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও বড় ভূমিকা পালন করে। কেননা দরিদ্রদের তুলনায় তারা ভালো সরকারি সেবা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আরও বেশি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা দাবি করতে পারে। প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, এমন সব নীতিকেও তারা সমর্থন দেয়। মধ্যবিত্তরাই অভ্যন্তরীণ বাজার বড় করে। কোভিড মহামারীর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস ছিল আফ্রিকায়, ৪৯ কোটি ৪০ লাখ। দ্বিতীয় স্থানে দক্ষিণ এশিয়া, ১০ কোটি ৪০ লাখ। আর সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত ছিল পূর্ব এশিয়ায়, ৬৭ কোটি ২০ লাখ।

মধ্যবিত্ত কারা, এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে আয়ের দিক থেকে বিশ্বের মানুষকে সাধারণত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন : দরিদ্র, স্বল্প আয়ের মানুষ, মধ্য আয়ের মানুষ, উচ্চমধ্যম আয়ের ও উচ্চ আয়ের মানুষ। যারা দিনে ২ ডলারের কম আয় করে, তারাই দরিদ্র বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দিনে ২ দশমিক শূন্য ১ ডলার থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত আয় হলে তারা নিম্নআয়ের মানুষ, ১০ দশমিক শূন্য ১ ডলার থেকে ২০ পর্যন্ত আয়ের মানুষরাই মধ্যম আয়ের, ২০ দশমিক শূন্য ১ থেকে ৫০ ডলার আয় হলে উচ্চমধ্যম আয়ের ও দিনে ৫০ ডলারের বেশি আয় হলে তারা উচ্চ আয়ের শ্রেণিতে পড়বে। তবে দেশভেদে এই সংজ্ঞা বদলে যায়।

গবেষকদের মতে, ২০ বছরের আয়ের দিক থেকে দুই বড় বিজয়ী হচ্ছে বিশ্বের অতিধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আয় বেড়েছে মূলত পূর্ব এশিয়ার চীন, দক্ষিণ এশিয়ার ভারত এবং সাবসাহারা আফ্রিকার কিছু অংশের মধ্যবিত্তদের। আর অতিধনীদের বাস ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ১ শতাংশের আয় বেড়েছিল ৬০ শতাংশ, আর বিশ্বের মধ্যবিত্তের বেড়েছিল ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। আয় ও বৈষম্য নিয়ে যে রেখাচিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল তা এলিফ্যান্ট কার্ভ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। এর ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিবিদরা কাজ করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে এই উপাত্ত ব্যবহার করলেও সবশেষ ব্যবহার হয় ২০১৬ সাল পর্যন্ত। যদিও ২০২১ সালে এসে পাল্টে যাচ্ছে অনেক হিসাবই।

চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু ১৯৭৮ সালে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে। পরের চার দশকের মধ্যে চীন বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯১ সালেও চীনের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ ছিল দরিদ্র। বিশ্বে সেই চীনেই এখন সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত। গবেষকরা বলছেন, চীনের এই অগ্রযাত্রার পেছনে বড় ভূমিকা মধ্যবিত্তের। চীনের উন্নয়নে মধ্যবিত্তের ভূমিকায় একাধিক গবেষণা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বাড়তে থাকা মধ্যবিত্তই দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারক। উদ্যোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই বেশি আসে। তারা সমাজে উৎপাদনশীলতা বাড়ায় ও কর্মসংস্থান তৈরি করে, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ মানব পুঁজি আহরণ ও সঞ্চয়ের ওপর জোর দেয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণ এবং মধ্যবিত্তরা দরিদ্রদের তুলনায় বেশি ভোগ করে এবং একটু বেশি গুণগত মানের পণ্য বা সেবা পেতে কিছুটা বেশি খরচ করতেও রাজি থাকে। এর মাধ্যমে মধ্যবিত্তরা বাজারে যে চাহিদা সৃষ্টি করে, তা বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করে।

গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মধ্যবিত্তরা প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, এমন সব নীতিকেও তারা সমর্থন দেয়। মধ্যবিত্তরাই অভ্যন্তরীণ বাজার বড় করে। করোনার ক্ষত সামলিয়ে উঠতে পারেনি শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তসহ খেটে খাওয়া মানুষ। এই ক্ষত না শুকাতেই শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এমন দুঃসময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

বর্তমান বিশ্বে দুর্বিষহ-ভয়ঙ্কর-ভয়াবহ এক অবস্থা চলছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। কমেছে মানুষের শ্রমের মূল্য। করোনার সময় যে বেতন কমেছিল, তা এখনো একই রয়েছে। এরপরও প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে। মধ্যবিত্তের হাহাকার বাড়ছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষগুলো ছুটছে।

গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন, বাড়িভাড়া বেড়েছে। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত কারও অবস্থা ভালো নেই; কিন্তু মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে। তাহলে উপায় বা করণীয় কী? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহল থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ এই চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত ২০২২ সালে এসে সেটি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩৫ টাকা। এতে কী দাঁড়াল- পণ্যমূল্যের বাস্তবতা সরকারি হিসাবের সঙ্গেও মিলে না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ অসময়ে বন্যা, নদীভাঙন, কোথাও অনাবৃষ্টির কারণে ফসলহানি। বন্যার ফলে বহু বাড়িঘর, স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন দুর্যোগজনিত কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্ট হয়েছে। এর কারণে অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত পড়েছে। দেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে এবং নিম্নবিত্তের মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, যথাসময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দুর্বলতা। মধ্যবিত্তের সংখ্যা যদি বর্তমান হারে নামতে থাকে। তবে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়বে। প্রতিটি দেশে মধ্যবিত্ত একটি বড় সামাজিক শক্তি। সারাবিশ্বে চলমান খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের গতি-প্রকৃতি, মূল্য বাড়া-কমা নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়িত্বের ওপর। চলমান এ যুদ্ধ শুধু খাদ্য, জ্বালানি ও পণ্য সরবরাহকে সংকটে ফেলেনি, কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করেছে, সংকুচিত হচ্ছে মানুষের কাজের ক্ষেত্র। বিশ্বব্যাপী চলমান এ দুর্যোগের সমাপ্তি নির্ভর করছে যুদ্ধের সমাধানের ওপর তথা স্থায়িত্বের ওপর। এরই মধ্যে জাতিসংঘ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপেও এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন বলছে, দুর্ভিক্ষ আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা ও খরা বাড়ছে।

বিশেষ করে এ যুদ্ধের প্রভাবে এরই মধ্যে বাংলাদেশে ডলার সংকট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ও করোনা পরিস্থিতি দেশ ও মানুষকে বিপাকে ফেলছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। বরং যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এরই মধ্যে দেশের মানুষ খাবার কম গ্রহণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাতাসে কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের সর্বাধিক উষ্ণতম বছর অতিক্রম করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে বিশ্ব’ বলে আশঙ্কা জাতিসংঘের।

এ অবস্থায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এ কথা সত্য, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সারাবিশ্বেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে- সরকারের তরফ থেকে এমনটি বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত কিনা, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অতীতে দেশের অর্থনীতি নানামুখী প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ অতিক্রম করে এগিয়েছে। দেশের পরিশ্রমী মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপে করোনা মহামারীর ধকল থেকে মানুষের জীবন ও জীবিকার চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকারকে আরও সঠিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করে সগুলো মোকাবিলার পদক্ষেপ নিতে হবে, তা না হলে সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।

পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নতুন ভোগ বাস্কেট প্রণয়ন করা, প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করা, নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ও কর কমানো, বিলাসী পণ্য ও বিদেশি ফল আমদানির লাগাম টানা, বাজারে মনোপলি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা। বিদ্যমান জ্বালানি সংকট নিরসনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া এবং অপচয় রোধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্যপণ্যের তালিকার ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রয়েছে। এসব পণ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা একই সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে। জ্বালানির দাম কমানো, অর্থ সংগ্রহের জন্য কর, জিডিপি বাড়ানোর বিষয়টি ভাবা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *