ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ প্রয়োজন

করোনার নেতিবাচক প্রভাবে আয় কমেছে ৮৪ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার। ৪০ ভাগ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। পণ্যমূল্য বাড়ায় ২১.৩ শতাংশ উদ্যোক্তা প্রতিকূল অবস্থায়। ২২ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা ঋণের কিস্তির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেননি। সাড়ে ৫ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাননি। ২১ দশমিক ৩ শতাংশ উদ্যোক্তা পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সঞ্চয় ভেঙেছেন ৪৭ শতাংশ উদ্যোক্তা। ২১ শতাংশ উদ্যোক্তা নিজের সম্পদ বিক্রি করেছেন। করোনা সংক্রমণে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অভিঘাতের বিষয়ে ‘বাংলাদেশের ক্ষদ্রঋণ গ্রাহকদের ওপর করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টার্নেটিভ ফাইন্যান্সিং ইনস্টিটিউশনস (ইনাফি) বাংলাদেশ এই গবেষণাটি পরিচালনা করে।
করোনার পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের ৫৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে, ৪৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ খরচ কমিয়ে এবং ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ উদ্যোক্তা সম্পদ বন্ধক রেখে টিকে রয়েছে। এখন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নীতি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কেননা গ্রামীণ অর্থনীতির বড় অংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তাদের কোনোক্রমেই অবহেলা করা যাবে না।
করোনার কারণে মাইক্রো ফাইন্যান্সের ঋণগ্রহীতারা গড়ে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা ও মাইক্রো ইকোনমিকস ঋণগ্রহীতারা গড়ে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনার সময়ে ডিজিটাল আর্থিক সেবা ব্যবহার করে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করোনার আগে এই সেবা ব্যবহার করলেও করোনার পর তা বেড়ে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। তবে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশই জানেন না কীভাবে ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবহার করতে হয়। করোনার সময়ে আমরা সবাই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। আমরা আসলে এখন হিসাব করছি, এ সময়টাতে আমরা কী পেয়েছি আর কী হারিয়েছি। অধিকাংশ কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেলেও আমাদের কিছু প্রাপ্তিও রয়েছে। বিশেষ করে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ধারণা নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু অর্থায়নে নারী উদ্যোক্তাদের প্রবেশাধিকার, বিশেষ করে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীর সমস্যা কমবেশি একই রকম রয়েছে।

নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক খাতে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি বুঝতে গেলে সম্পদ ও অর্থে তার অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা, তা বোঝাও জরুরি। এ বিষয়টি সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এখন খুব গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। একজন পূর্ণবয়স্ক নারী আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ নিতে চাইলে তাকে পুরুষ গ্যারান্টার হাজির করতে হয়। কেন হাজির করতে হয়? এর ভিত্তির জায়গাটি হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর নামে সম্পদ নেই, নারীর নামে জমি নেই, নারীর নামে বাড়ি নেই। তা হলে একজন নারী কী করে সম্পদ জমানত রেখে অর্থ উত্তোলন করে নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারেন। একটা দীর্ঘ সময় ধরে বলা হচ্ছে, সারাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অথচ উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র, মাঝারি, এমএসএমইতে কী পরিমাণ মানুষ সম্পৃক্ত আছেন, তার কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যেমন আমাদের নেই, তেমনি নেই কত শতাংশ নারী। পরিসংখ্যান না থাকায় আমরা জানি না কত শতাংশ নারী উদ্যোক্তা আসলে কোভিডের ধাক্কায় হারিয়ে গেছেন বা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

করোনার প্রভাব ৮৫ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ওপর পড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর পড়া এ প্রভাব বাংলাদেশ ও এর অর্থনীতির ওপর একটি বড় ধাক্কা। অনানুষ্ঠানিক খাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৮০ শতাংশ বলছেন, তাদের আয় কমেছে। এই গ্রুপের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছেন নারী উদ্যোক্তারা। মহামারীসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের এ রকম পরিস্থিতিতে কীভাবে খাপ খাওয়াতে হয়, তা দেখিয়েছে। এখানে কিছু দক্ষতা উন্নয়নের দরকার আছে। নারী উদ্যোক্তাদের অ্যাকসেস টু ফিন্যান্সের নীতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী হলেও চ্যালেঞ্জ দেখা দেয় এর বাস্তবায়নে। মাঠপর্যায়ের এই ঋণ বিতরণের জায়গায় অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল এক হাজার নারী উদ্যোক্তার দক্ষতা উন্নয়ন এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদে টেকসই আয়ের সঙ্গে যুক্ত করা। আমাদের সমস্যাকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে হবে। কারণ বাংলাদেশের যে গ্রুপ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা সামাজিকভাবেও অনেক পিছিয়ে আছে।

বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) খাত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ ব্যবসা রয়েছে এবং তার মধ্যে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ সিএমএসএমই। আর এর মধ্যে আবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ হচ্ছে নারীদের দ্বারা পরিচালিত। নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা মূলত তিনটি চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে এসেছি, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের ব্যাংকিং প্রক্রিয়া, অনানুষ্ঠানিক খাত হিসেবে চাওয়া সহযোগিতা এবং বর্তমান যুগে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে কী ধরনের সাহায্য বা পারদর্শিতা তারা প্রত্যাশা করেন।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক উচ্চ। ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করার সময়সীমা অত্যন্ত কম। অনেক উদ্যোক্তা ঋণ গ্রহণের জটিল প্রক্রিয়ার কথাও বলেছেন। ঋণ গ্রহণের শর্তগুলো নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অনেকাংশেই খাপ খায় না। কারণ ঋণ নিতে হলে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর আওতায় কিছু নারী উদ্যোক্তাকে আনা যেতে পারে, যারা করোনা-পরবর্তী সময়ে খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প সিএমএসএমই নারীদের জন্য ইন্স্যুরেন্স সুবিধার প্রয়োজন। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণগুলোকে সুদমুক্ত করার সুপারিশ করছি। এমন অনেক নারী আছেন, যাদের ঋণ নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। সে ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্যাকেজের ছোট একটি অংশ অনুদানে থাকতে পারে।

নারীর কাছে তথ্য নেই, এটি খুবই সত্যি কথা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি আর্থিক বিষয়ের জ্ঞান। ব্যাংকের অনেক তথ্য প্রয়োজন হয়। এত তথ্য পূরণ করতে গিয়ে অনেক ছোট ছোট উদ্যোক্তা ভয় পেয়ে যান। এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে প্রথম অর্থবছরে বলা হচ্ছে ৭৬ বা ৭৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে কতভাগ সিএমএসই পেয়েছে, তাতে বড় ধরনের সন্দেহ আছে। কিন্তু ২০ ভাগের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পেয়েছেন কিনা, সন্দেহ আছে মাঝারি উদ্যোক্তাদের বেশি দেওয়া হয়েছে। নারীরা পেয়েছেন ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা সার্কুলার আছে, ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নারী উদ্যোক্তাদের কোল্যাটারাল ছাড়া ঋণ দিতে হবে। নির্দেশনা থাকলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ইতিহাস ক্ষুদ্রশিল্প উন্নয়নের ইতিহাস। বিসিক জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিসিক ই-কমার্স ও ই-মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছে এখন। নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী করতে হবে এবং আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আর্থিকভাবে তাদের স্বাবলম্বী করে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে হবে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি না করতে পারলে আমরা ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের কথা বলছি, তা সম্ভব হবে না। বর্তমানের ছোটরাই এক সময় সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে। এর জন্য বড় শিল্পের সঙ্গে ছোট ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে এক সংযোগ-সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এটা করা গেলে বড়-ছোট উভয়েই লাভবান হবে। যা দেশে টেকসই শিল্পায়ন নিশ্চিত করবে।

ঋণ বিতরণের পরিমাণ খুব বেশি বাড়ছে না। এটা যাতে আরও বাড়ে সেজন্য চুক্তিবদ্ধ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আরও তৎপর হতে হবে। কারণ ভালো উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অনেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে হয়তো তারা এখনো ঋণ সুবিধা চালু করতে পারেনি। তবে তারা যেন খুব শিগগিরই এই সুবিধা চালু করে- এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঋণ বিতরণের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ম্যানুয়াল-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই আলোকে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে এ স্কিমের আওতায় ঋণ বা বিনিয়োগ গ্যারান্টির পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্যারান্টির মেয়াদ ধরা হয়েছে এক বছর। পরে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরও বেশি গ্রাহককে সুবিধা দিতে ২৫ হাজার টাকার ঋণকেও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য আবারও প্রণোদনা দরকার হবে। চলমান প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার আগেই তা ঘোষণার প্রয়োজন হবে। পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং ব্যবসায়িক ধরন পরিবর্তন করতে না পারলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। একই সঙ্গে যুগের সন্ধিক্ষণ হিসেবে ব্যাংকিং কিংবা মার্কেট স্ট্র্যাট্যাজির স্রোতের সঙ্গেই উদ্যোক্তাদের এগোতে হবে। তবে এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতিও আরও সহজ করা জরুরি। ছোট উদ্যোক্তারাই এক সময় বড় হয়। তাই সরকারকে ছোটদের প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে। সহযোগিতা পেলেই ছোটরা বিকশিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *