ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী শুধু সংকটই বৃদ্ধি করছে


হীরেন পণ্ডিত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম মার্কিন ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ যুদ্ধের ফলে আগ্রাসী শক্তিগুলো লাভবান হচ্ছে, অস্ত্রের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ছে, মানুষ গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হচ্ছে প্রতিনিয়ত, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির করাল গ্রাসে পড়ছে মানুষ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে গেছে বা থেমে যাচ্ছে প্রায় সব কিছুই।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তিতে নতুন করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন ফার্ম, ব্যাংক, উৎপাদকসহ বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন অর্থ বিভাগ বলছে, এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার বিরুদ্ধে জারিকৃত পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়াতে ক্রেমলিনকে সহায়তা দিয়েছে। বিবিসি বলছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সামগ্রী যেন রাশিয়ার হাতে না পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে এবারের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। রাশিয়া ও রাশিয়ার বাইরে চীনসহ বিভিন্ন দেশের অন্তত ৯০টি কোম্পানি এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। এদিকে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে যতদিন দরকার, ততদিন পর্যন্ত ইউক্রেনে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান জারি রাখার কথাও বলা হয়েছে। এদিকে জ্বালানি অবকাঠামো শক্তিশালী করতে ইউক্রেন ও তার প্রতিবেশী মলদোভায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তাও ঘোষণা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হলো-তবু যুদ্ধ থামার কোন লক্ষণ নেই। ২৪ ফেব্রæয়ারি ২০২২ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধ বন্ধের কথা উঠলেও ৩৬৫ দিনেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি কেউই। যুদ্ধ এখন শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। সবাই চাইছে সমাধান তবুও কোথায় যেন আটকে আছে সব। তুরস্ক এগিয়েছে, চেষ্টা করেছে ফ্রান্সও কোন কাজ হয়নি। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবসহ কয়েক দফা শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানও। শুক্রবার বর্ষপূর্তির দিনেই প্রথমবারের মতো যুদ্ধ বন্ধে ১২ দফার একটি শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করল চীন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে ‘আগুনে ঘি ঢালা’ বন্ধ করতে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে বেইজিং। সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান দেখানো সর্বজনীন স্বীকৃত আন্তর্জাতিক আইন কঠোরভাবে পালন করা। জাতিসংঘ সনদের নীতি মেনে সব দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখÐতা সমুন্নত রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ছোট হোক বা বড়, শক্তিশালী অথবা দুর্বল, ধনী কিংবা দরিদ্র সব দেশই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য। সবার অধিকার সমান। সব পক্ষের উচিত যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার মৌলিক নিয়ম সমুন্নত রেখে আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার রক্ষা করা। দ্বিমুখী আচরণ করা থেকে বিরত থাকা। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য অন্য দেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল থাকার যৌক্তিকতা ও নিরাপত্তা অর্জনে সামরিক শক্তি সম্প্রসারণ করাও উচিত নয়। সবাইকে সাধারণ, সর্বাঙ্গীন, সহযোগিতামূলক, ভারসাম্যপূর্ণ কার্যকর টেকসই নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা।
ক্ষতি ছাড়া যুদ্ধ-সংঘাত কারোরই উপকার করে না। আগুনে ঘি ঢেলে উত্তাপ ছড়িয়ে আর উটকো উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়িয়ে চলতে হবে। সংকটকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধবিরতির জন্য সবার উচিত দু’টি দেশকে আলোচনার দিকে ধাবিত করা।
সংলাপ আর আলোচনাই ইউক্রেন সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান। দ্ব›েদ্বর শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা। সবার নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করা উচিত। মানবিক বিষয়কে রাজনীতিকরণ করা উচিত নয়। সকল নাগরিকদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা। নারী, শিশু এবং সংঘর্ষের শিকার অন্যদের সুরক্ষা দিতে হবে। যুদ্ধবন্দিদের মৌলিক অধিকারকে সম্মান করা উচিত। সব পক্ষকেই পারমাণবিক সুরক্ষা কনভেনশনসহ মনেে চলতে হবে। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি বা ব্যবহারের বিস্তার রোধ করা। রাশিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন আর জাতিসংঘের স্বাক্ষরিত কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তিকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া। জাতিসংঘকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সমর্থন করতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অননুমোদিত একতরফা নিষেধাজ্ঞা সংকট আরো বাড়াচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার বিরোধিতা করা প্রয়োজন। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সংঘাত-পরবর্তী পুনর্গঠনে সহায়তা করার ব্যবস্থা সকলকেই নেয়া।
যুদ্ধের প্রভাবের কারণে এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে সারা বিশে^। এর বিপরীতে অর্থনৈতিক মন্দায় বাড়েনি মানুষের আয়। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাকে খাবার উপকরণ কেনা কমাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে কমাতে হচ্ছে ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আয় ও ব্যয়ের মধ্য সমন্বয় করতে মানুষ প্রথমে দৃশ্যত অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব খরচ কমিয়েছে।
বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় তা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশের সমস্যায় ফেলেছে এই যুদ্ধ । যার নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। এখন এর প্রভাবের ধাক্কা আসছে ভোক্তার ওপর। মন্দার প্রভাবে গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। এতে আমদানি পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাÐ স্থবির হয়ে পড়ায় ও বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। এমন কি যারা কর্মে ছিলেন তাদের অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। চাকরিরতদের মধ্যে অনেকের বেতন-ভাতা নিয়মিত হচ্ছে না।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের ভোগের প্রবণতা কমে গেছে। এর মধ্যে চাল, প্রোটিন ও ভোজ্যতেলের ব্যবহার কমেছে। অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে সংকট বিদ্যমান রয়েছে। তাদের আয় কম, খাদ্যের দাম বেশি, তাই চাহিদামতো খাবার কিনতে পারছেন না।
খাবারের পাশাপাশি অত্যবশ্যকীয় সেবার দাম বেড়েছে লাগামহীন। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম দুই দফায় বেড়েছে ১০ শতাংশ। গ্যাসের দাম দুই দফায় বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য সব পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণপরিবহণের ভাড়া প্রায় শতভাগ। এসব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে লাগামহীন।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসার চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। ফলে তারা সঞ্চয় করতে পারছেন না। এমন কি আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে জাতীয় সঞ্চয়ে টান পড়েছে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের হাতে রাখছে। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের পরিবর্তে মানুষের হাতে থাকা টাকা বেড়েছিল ১ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছে ৩১ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে বেশি টাকা এখন মানুষের হাতে চলে এসেছে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে দুই ধরনের অপুষ্টির শিকার। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগজনিত পুষ্টিহীনতা। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতার মধ্যে রয়েছে, শিশুরা খর্বকায় ও কম ওজনের হচ্ছে। এফএও’র প্রতিবেদনে অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের গড়ে যা খেতে হয় তা খেতে পারে না। এ হিসাবে নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে তারা নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
আমাদের এই রক্তক্ষয়ী ও বিপর্যয়কর সংকটের অবসানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে মানুষকে গভীরভাবে আঘাত করছে, বিশেষ করে সরাসরি সংঘাতের সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বিশ্বের মানুষকে বেশি আঘাত করছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের অব্যাহত ও প্রসারণশীল প্রভাব এবং যুগপৎ অন্যান্য সংকট আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে এটি উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং আমাদের কোভিড পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা ও এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত করেছে। তবু কোনো একক দেশ একা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বৈশ্বিক সংহতি।
বিশ্ব নেতাদের বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হবে। তাৎক্ষণিক উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করার বৈশি^ক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। সংঘাতের সময় খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে ক্ষতির হাত থেকে দূরে রাখার জন্য ভবিষ্যতের যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা। বিশ্ব বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সাহসী ও ব্যাপক পদক্ষেপের প্রয়োজন এবং বিশ্ব বাণিজ্য ও রফতানি আয়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ন্যায্য অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং কার্যকর খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দিতে হবে। নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করতে প্রযুক্তি সহায়তা বাড়াতে হবে। জলবায়ু সহযোগিতার জন্য বৈশ্বিক কাঠামোকে আরও কার্যকর এবং ন্যায্য করার আহ্বান জানান। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উদ্বেগ নিরসনে কাজে লাগানো উচিত।
সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের ব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্য নীতি গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্দেশনা প্রদান করে এবং আমরা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সঠিক নীতি বিকল্পগুলো সামনে আনতে অন্য অংশীদারদের সাথে কাজ করতে হবে।
পারমাণবিক শক্তিতে যার পাল্লা ভারী হোক না কেন, এই অস্ত্র যেন কখনোই ব্যবহার না হয়, এমন আশা সবারই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও রক্তঝরা পথে না এগিয়ে কূটনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে-এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও। তার বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, ২০২৩ সালেই এই যুদ্ধ শেষ হবে, ফুরাবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি।
হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *