বর্তমানে চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এখানে টিকে থাকতে হলে শ্রম ও দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দক্ষতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। মানসম্মত প্রশিক্ষণ ছাড়া যা অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল বেশি মাত্রায় পেতে হলে প্রশিক্ষণ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রশিক্ষণ খাতে সব ধরনের সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। সরকার ও বেসরকারী খাতের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো গতিশীল করে তুলতে হবে তিনি উল্লেখ করেন।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলেও সেগুলো দেশের অর্থনৈতিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষ জনবল তৈরিতে সহায়তা করছে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি করতে হবে এবং প্রশিক্ষণকে সাজাতে হবে তেমনি করে।
প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। গত পাঁচ দশকের এ অর্থনৈতিক যাত্রায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও অদক্ষ শ্রমশক্তিই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩৬ সালে ২৫তম উন্নত দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আরো উন্নত দেশে পরিণত হওয়াই এখন মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও নিবেদিত কর্মী বাহিনী যাদের ছাড়া উন্নয়নের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা মোটেও সম্ভব নয়।
আর চৌকস ও পেশাদার কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার প্রধান মাধ্যম হলো প্রশিক্ষণ। উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদের জোগান নিশ্চিতে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দিতে হবে।
পেশাগত কাজের মান উন্নয়নে দক্ষতা বৃদ্ধি উন্নয়নের প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ মানুষকে নিয়মনিষ্ঠ, পারদর্শী, কর্মতৎপর ও দক্ষ করে তোলে। দেশের সামগ্রিক প্রশিক্ষণ খাতে এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান।
দেশের জনসংখ্যা বাড়লেও, দক্ষ ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ জনশক্তি তৈরির গুরুত্ব প্রদান করা হলেও সেই খাতে সমানুপাতিক হারে রাষ্ট্রীয় বাজেট ও ব্যয় বাড়েনি। এ খাতে বরাদ্দ যৎসামান্য। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মানসম্মত প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দুনিয়া আমূল বদলে গেছে। দেশেও এর ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু দেশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আধুনিকভাবে এর বিন্যাস করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠছেনা।
দক্ষ প্রশিক্ষকেরও ঘাটতি রয়েছে। একে তো চাহিদা অনুপাতে প্রশিক্ষকের সংখ্যা কম, তার ওপর যারা রয়েছে তাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। প্রশিক্ষণের উন্নয়নের জন্য গবেষণা খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও এক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।
উন্নয়নের প্রতিটি স্তরের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। না হলে অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলে উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করেছে। তার জন্য তারা গবেষণা, প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটি চিহ্নিত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এশিয়ার উন্নয়ন বিস্ময় দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার আজকের সাফল্যের পেছনে দক্ষ প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা শিল্পায়নের উপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ খাতের ব্যাপক সংস্কার করেছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতও প্রশিক্ষণে অনেক এগিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন খাতে তারা গড়ে তুলেছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। তার সুফলও দৃশ্যমান। দেশটি এখন দক্ষ ব্যবস্থাপক ও মানবসম্পদ জোগানে বিশ্বের শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে।
বিআইডিএসের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত যেমন তৈরি পোশাক, আইসিটি, নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, হালকা প্রকৌশল, স্বাস্থ্যসেবা, জাহাজ নির্মাণ আর ওষুধ শিল্পে প্রায় সাত কোটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি ও ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন হবে। এখন দক্ষ জনশক্তির জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও এ কারণে ব্যয় করতে হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তির এ ঘাটতি মেটাতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে গবেষণা, প্রশিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ জোরদার এখন সময়ের দাবি।