শ্রমনির্ভর অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সে যাত্রা শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ এ যাত্রার মাধ্যমে। ২০২৫ সাল নাগাদ আইটি খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের প্রত্যাশা রয়েছে বাংলাদেশের। দেশে আইটি ডিভাইস উৎপাদন শিল্পে অন্তত এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের আশা করা হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ আইটি খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশে তৈরি ডিজিটাল ডিভাইসের রপ্তানি আয় বর্তমানের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। একই সময়ে আইসিটি পণ্য ও আইটি-এনাবল সার্ভিসের অভ্যন্তরীণ বাজারও ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগামী চার বছরের মধ্যে দেশে-বিদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য বাজার ধরতে ডিজিটাল ডিভাইস তথা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের মতো আইটি পণ্য বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন শিল্প স্থাপনের সুযোগ সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্থানীয় পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ রোডম্যাপ নিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। এ রোডম্যাপের সঠিক বাস্ত—বায়ন হলে দেশে আইটি ডিভাইস উৎপাদন শিল্পে অন্তত এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। প্রায় ২০০ কোটি ডলারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হবে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন।
২০১৭ সাল থেকে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে। এতে প্রধান সাতটি ক্ষেত্র বিবেচনায় নেয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সহায়ক পরিবেশ।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ করেছে এখন বাংলাদেশ। সময়ের ব্যবধানে দেশে শিক্ষায় অবকাঠামোগত ও সংখ্যাগত বড় উল্লম্ফন হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে এখনো একটা জ্ঞান ও প্রযুক্তিবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। এ পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে বেশকিছু ফ্যাক্টর কাজ করছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নতুন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৬৪। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বরাবরই ভালো করছে স্ক্যান্ডিনেভীয়ান দেশগুলো। এবারো শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে সুইজারল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে সুইডেন। তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম পাঁচে আছে স্ক্যান্ডিনেভীয় আরো দুটি দেশ: ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করেছে সিঙ্গাপুর। দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ষষ্ঠ। ভালো অবস্থানে আছে ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন। মূলত প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধা, মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর সুশাসিত ও জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা দেশগুলোকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে।
উন্নয়নের নতুন ধাপের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক অত্যাবশ্যক প্রযুক্তি আমাদের আয়ত্তের বাইরে আছে।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অধিকাংশ জ্ঞানচর্চা ধাবিত হয় শিল্পের উৎকর্ষতা বা শিল্পের উন্নতির দিকে খেয়াল রেখে- তা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে হোক বা অন্য কোনো ভারী শিল্পের বিষয়েই হোক। সব মানুষ যেন শিল্প উৎপাদন বা কনজ্যুমেবল গুডসের দিকে সব জ্ঞান নিবেদিত করছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে যারা শিল্পের ক্ষেত্রে উন্নত দেশ, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা- তারা শিল্পের পাশাপাশি মানুষের নৈতিক মান উন্নয়নেও অনেক অগ্রসরমাণতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেখানে মানুষ প্রযুক্তি, শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি তাদের নৈতিক মান উন্নয়নেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের জ্ঞানচর্চা এটি শুধু বিজ্ঞানচর্চায় নয়। তারা শিল্প উন্নতির পাশাপাশি জ্ঞানের সব শাখায়, বিশেষ করে মানবিক দর্শন, মানুষের মানবিক বিকাশ, মানবতাবোধ, ভাতৃত্ববোধের চর্চা ও লালন করার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন সমভাবে। তারা শিল্প ক্ষেত্রে প্রডাকশন এবং পার ক্যাপিটা ইনকাম বৃদ্ধির জন্য গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ তরুণ। এ তারুণ্যকে নিয়েই এগিয়ে যেতে আমাদের। দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণকে প্রশিক্ষিত করে আমরা যদি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে খুবই দ্রæত তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ববাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করতে পারব। এ তরুণ জনগোষ্ঠীই আমাদের সম্পদ। সরকার আইসিটি খাতে এ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে তাদের প্রশিক্ষণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আরো নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে এবং তাদের অংশগ্রহণে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও চলছে কর্মযজ্ঞ। প্রয়োজনীয় কর্মকাÐ সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে দিতে দেশের প্রায় পাঁচ হাজার ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার।
এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়াকে আরো সহজলভ্য করে তুলতে হবে। পরীক্ষার ফর্ম পূরণ, চাকরির আবেদন, করোনা পরীক্ষার নিবন্ধন, কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও নেওয়া যাচ্ছে ঘরে বসেই। ব্যাংকে না গিয়ে মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং এবং আই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজেই সেবা নিতে পারছে। করোনাকালে ঘরে বসে অনলাইনে অফিস করছে, ক্লাস করছে। এসবই সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে।
বাংলাদেশে তারুণ্যেও নেতৃত্বের বিকাশ, তাদের স্বপ্ন দেখানো, কর্মসংস্থান, তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা নির্মাণে, প্রযুক্তি উন্নয়নে সহায়তা, শিল্পায়ন-গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে আরো সহজ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে আরো কাজ করতে হবে। এদেশে অফিস-আদালত থেকে শুরু করে টেন্ডার কিংবা ব্যাংকের লেনদেনের যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, সেই ডিজিটাইজেশনের কাজকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। করোনা মহামারি ও লকডাউনের সময় যখন বিশ্বজুড়ে অনলাইন যোগাযোগ একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। কৃষিভিত্তিক ও শ্রমভিত্তিক সমাজ ক্রমান্বয়ে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে পরিণত হচ্ছে এটি একটি আশার কথা। তবে নতুন উদ্যমে একটি জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ বিনর্মিাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।