জগন্নাথ হল কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

হীরেন পন্ডিত: ১৯৮৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সেশন জ্যামের কারণে ১৯৮৬ সালের প্রথমদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর কিছুটা ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করছি। মাস্টারদা সূর্যসেন হলে এলাকার এক বড় ভাইয়ের রুমে থেকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কিছুদিন পর সংবাদ পেলাম ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। দুরু দুরু বুকে নেত্রকোণা থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ট্রেন ঢাকা এসে যখন পৌঁছায় সূর্য তখন অনেকটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। জগন্নাথ হলে এসে পৌঁছার পর ৩১৮ নাম্বার রুমে আমি জ্যোতিষদার জন্য অপেক্ষা করলাম এবং এখান থেকেই জগন্নাথ হলে আমার যাত্রা শুরু। তখন এটিকে ইস্টহাউজ বা পূর্বভবন বলা হতো গত কিছুদিন হলো জরাজীর্নতার কারণে ভবনটিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এখন বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে।

প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, ছোট থেকেই আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন ছাত্র। তাই খুব বড় প্রত্যাশা কখনোই করতে পারিনি। কারণ পড়াশোনায় মন বসানো আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো। তাও যেটুকু হয়েছে মা বাবার কল্যাণে, আর বড় ভাইবোনদের চোখ রাঙানোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের গেটে টানিয়ে দেয়া ফলাফলের তালিকায় গিয়ে দেখলাম ঠিক যেমনটা আন্দাজ করেছিলাম মাঝামাঝি পর্যায়ের একট জায়গায় আমার রোলটা অবস্থান করছে। খুব একটা আনন্দিত বা হতাশ কোনোটাই হইনি। বিষয় বণ্টনের আগে বড়ভাইদের সাথে পরামর্শ করলাম এবং বললাম মধ্যবিত্ত কোন একটা বিষয় পড়ার জন্য পাওয়া যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে আমার পরিবারে শিক্ষকতা পেশার প্রতি একটা আকর্ষণ ছোট বেলায়ই লক্ষ্য করেছি, আমার ভাইবোনেরা প্রায় সবাই শিক্ষক। আমিও তাদের দেখে নিজেকে সেরকম ভাবতে শুরু করেছি। তার পর বিষয় বণ্টনের সময় বলা হলো দর্শন অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পেতে পারি, তখনকার কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল মোমিন চৌধুরী আমাকে বললেন। দার্শনিক হবার সুপ্ত একটি বাসনা থেকে দর্শনকে পড়ার বিষয় হিসেবে পছন্দ করলাম। কিন্তু সবার পরামর্শে এবং সকল স্কুল ও কলেজে সহজলভ্য বিষয় হিসেবে দর্শন পরিবর্তন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম যাতে পাশ করে অন্তত স্কুলে বা কলেজে পড়ানো যায়।

আমার ভর্তির আগের বছর ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিলো। এসেম্বলী ভবনের ছাদ ধ্বসে ৩৯ টি তরতাজা প্রাণ হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের মাঝ থেকে, যে বেদনা আমাদের বয়ে যেতে হবে চিরকাল। এই জগন্নাথ হল এদেশের প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে রেখেছে গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন বিশিষ্ট দার্শনিক ড. জি সি দেব, ড. সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যসহ আরো অনেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞের নিরব সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের এই জগন্নাথ হল।

আমাদের ভর্তির পর পরই শুরু হয় অক্টোবর স্মৃতিভবন নির্মাণের কাজ। দিন রাত শুধু কংক্রিট তৈরির মেশিনের শব্দ, ইট, বালু আর সিমেন্টের ছড়াছড়ি। পরে এই ভবনের ৪৪৮ নাম্বার কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকী দিনগুলো (১৯৯৫ সাল পর্যন্ত) এখানেই কাটিয়েছি। এরশাদ সাহেব তখন দুর্দণ্ড প্রতাপে তার সামরিক শাসন পরিচালনা করে যাচ্ছেন। ১৯৮৭ সাল প্রায় পুরো বছরটাকে এরশাদ ভ্যাকেশনে আমাদের কাটাতে হলো। ১৯৮৮ সালে এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা এদেশের মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করার আরেকটি প্রয়াস ছিলো যার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করলাম, কাজের কাজ কিছু হয়নি সংসদে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হলো, যার ফলাফল আমরা ভোগ করছি এবং এর দায়ভাগ বাংলাদেশকে বয়ে যেতে হবে আরো অনন্তকাল, কেননা আমরা যতই বলি, আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে আমরা ফিরে যাব এটা অদূর ভবিষ্যতেও বাস্তবায়িত হবে কিনা এটাই একটা বিরাট প্রশ্ন।

প্রয়াত বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী ড. ললিত মোহন নাথ ছিলেন আমাদের প্রিয় জগন্নাথ হলের তখনকার প্রাধ্যক্ষ। পরে অবশ্য আরো কয়েকজনকে প্রাধ্যক্ষ হিসেবে পেয়েছি যেমন ড. পরেশ চন্দ্র মণ্ডল, ড. জগদীশ চন্দ্র শুক্লাদাশ প্রমুখ। ড. প্রদীপ স্যার, ড. রতন স্যার ও ড. নিরঞ্জন স্যারসহ সব স্যারেরা আমাদের কে খুব সহযোগিতা করতেন।

এরশাদের সামরিক শাসন আর অনির্দিষ্টকালের বন্ধ থাকা ছিলো একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের জীবনের প্রায় ৮ বছর কেড়ে নিয়েছে ৪ বছরের দু’টি ডিগ্রী নিতে, অবশেষে ১৯৯৫ সালের কোন একদিন এক অজানার উদ্দেশ্যে জগন্নাথ হল ছেড়ে আসি। আমাদের সময়কার জগন্নাথ হলের বন্ধুুবান্ধবদের মাঝে এক অন্যরকম হৃদ্যতা ছিলো। আমি ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন একটি পরিবারে বড় হয়েছি, কিন্তু কেউ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। হলের রাজনীতিতেও সরাসরি সম্পৃক্ত হইনি। আমার কয়েকজন বন্ধু ছিলো রাজনৈতিক কর্মী এবং লেখালেখি নিয়ে থাকতো তাদের মধ্যে অসীম সমাদ্দার (সদ্য প্রয়াত) ও ড. তপন বাগচী (বর্তমানে বাংলা একাডেমীর ফকলোর বিভাগের উপ-পরিচালক), নিমাই মণ্ডলসহ আরো অনেকের নাম মনে পড়ে। নির্মল চ্যাটার্জী বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সদস্য ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা আমার ভালো বন্ধু। তাছাড়া অসীম কুমার উকিল, এমপি, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পঙ্কজ দেবনাথ, এমপি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবকলীগ, সুভাষ সিংহ রায়, জগন্নাথ হলের তৎকালীন ভিপি, বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, তাপস পাল সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবকলীগ আমাদের সিনিয়র ছিলেন। । বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী আমাদের এক বছরের জুনিয়র ছিলেন। বিধুভূষণ রায় ছিলো আমাদের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন এদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য। নিজেকে প্রায় উৎসর্গই করেছিলো সেজন্য, কিন্তু বর্তমানে বিআরডিবির কমকর্তা, কি করবে বেচারা এদেশ কি সমাজতন্ত্রকে বুকে ধরে রাখবে। যে দেশে আলোর বার্তার চেয়ে অন্ধকারের বার্তা ছড়িয়ে যায় নিমিষে, শিক্ষিত সমাজকেও অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতে দেখা যায় প্রায়ই। সে দেশে সমাজতন্ত্র!

আমার অনেক রুমমেট ছিলো সবার সাথেই অন্যরকম হৃদ্যতা ছিলো। তবে দুইজন রুমমেট ছিলো, রুমমেট না আমি বলি দুই ছোট ভাই, মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়ে বেশি। একজন অরুণ কুমার সরকার, আইন পাশ করার করার পর এখন রংপুরের ডাকসাইটে উকিল, ঢাকা শহর তার তেমন পছন্দ নয়, তাই রংপুরকে ঘিরে তার সব স্বপ্ন। কোনো সমস্যায় পড়লেই তার দ্বারস্থ হই আইনী পরামর্শ এর প্রয়োজন হলে। ওকে আমি এখনো তুই বলে সম্বোধন করি। আর একজন গৌতম চন্দ্র পাল, আমাদের সেই ছোট ভাইটি আজ বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা (যুগ্মসচিব)। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের সাহেবের পিএস হিসেবে কর্মরত। গৌতম সরকারের একজন দক্ষ, চৌকষ ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে এ যেন আমাদের সবার গর্বের বিষয়। ওদের নিয়ে কত স্মৃতি বুকে জমা হয়ে আছে।

আমাকে যদি বলা হয়, তোমার জীবনের ফ্ল্যাশ ব্যাকে তুমি কাকে চাও, আমি প্রথমেই বলবো আমার জগন্নাথ হলের দিনগুলোকে আমায় ফিরিয়ে দাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আমাকে ঋণী করেছে তেমনি জগন্নাথ হল আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রেখেছে। জয়তু জগন্নাথ হল, জয়তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

হীরেন পন্ডিত, প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *