স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অর্থপূর্ণ সমন্বয় প্রয়োজন


হীরেন পণ্ডিত: জীবন এবং জীবিকার মধ্যে এক চিরন্তন আন্তঃসম্পর্ক। জীবন-জীবিকার সন্ধানে মানুষ সমুদ্রের তলদেশ থেকে চাঁদে যাত্রা করেছে। জীবিকা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। জীবনের নিরাপত্তা এবং জীবিকার স্বচ্ছতার সমন্বয়ে জনগণকে একটি ব্যবস্থায় আনার জন্য একটি রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় দায়-দায়িত্ব পালন করে। দেশের প্রতিটি মানুষের দায়-দায়িত্ব ও সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জীবিকার সার্বিক নিরাপত্তা বলতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, চিন্তার স্বাধীনতা ইত্যাদি সব নাগরিকের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার দাবি করছে যে, তারা এ কাজটি অত্যন্ত সুচারুরূপে পালন করছেন। এটা সবাই স্বীকার করবেন যে, সরকার বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। সেই মর্যাদা রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেখানে সবার দায়িত্ব রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৪ বছর পূর্ণ করেছে। যদিও সারাবিশ্ব আজ এক অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে, বিশ্ব করোনা ভাইরাস মহামারীর কবলে পড়ে। ২০২০ এবং ২০২১ এই দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি যখন করোনা ভাইরাস মহামারী দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রভাব কোনো একটি দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতে, ১৪ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। বিশ্বমানের যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়েছে গত জুনে। এই সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সরাসরি রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত করেছে। রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলটি আগামী মার্চে চালু হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশের এই বিস্ময়কর সাফল্যের নেত্রী ও পরিকল্পনাকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ থেকে ২,৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। গত অক্টোবরে উদ্বোধন করা হয় দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পায়রা সেতু।
গত নভেম্বরে দেশের ২৫টি জেলার ১০০টি সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর পর বঙ্গবন্ধু-২ উৎক্ষেপণ করা হবে। আওয়ামী লীগ ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে। এজন্য রূপকল্প ২০৪১ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নতি করেছে। মানুষের গড় আয়ু এবং সাক্ষরতার হার বেড়েছে। ¯ু‹লগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগব্যবস্থাসহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি উন্নত হয়েছে। বেসরকারি খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে এবং ডিজিটাল সিস্টেম তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সূচকেও উন্নতি হয়েছে। জনসংখ্যার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন তরুণ, সারাদেশে ব্যবসায়িক উৎসাহের কোনো কমতি নেই। মোবাইল ফোন এখন সব মানুষের হাতে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ উন্নত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কিছু কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে, যা দেশটিকে তার পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকাশ করতে বাধা সৃষ্টি করছে।
আমাদের প্রধান সমস্যা হলো মানসম্পন্ন অবকাঠামোর অভাব। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচ, বন্দর, বিমানবন্দর এমনকি ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি সব ক্ষেত্রেই মানের বড় ঘাটতি রয়েছে বা অর্থপূর্ণ সেবা পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বাজেটের একটি বড় অংশ যাচ্ছে ভর্তুকি ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন এবং পুরনো ঋণের সুদ পরিশোধে। অবকাঠামো খাতের জন্য সামান্যই অবশিষ্ট থাকছে। তার পর ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা, নিয়ম-নীতির অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ তো রয়েছেই, এগুলো সমাধানের আলামত আমরা কবে দেখব? ঘাটতি রয়েছে শিক্ষায়, দেশের অনেক চাকরির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা মাধ্যমিক শিক্ষা। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কারণে দরিদ্র পরিবারের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ¯ু‹ল থেকে ঝরে পড়ছে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের জন্য চাপ থাকে। ¯ু‹ল-কলেজের শিক্ষার গড় মানও কম। সেই শিক্ষা আজ বেশিরভাগ চাকরির জন্যই যথেষ্ট নয়। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা এবং ছোট শহরে দুর্বল। আশ্চর্যজনকভাবে, উদ্বৃত্ত শ্রমসহ দেশে কর্মসংস্থানযোগ্য শ্রমিকের অভাব রয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে গত কয়েক বছরে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসহ অনেক অবকাঠামো উৎসাহের সঙ্গে গড়ে উঠলেও কিছু কিছু অব্যবহৃত পড়ে আছে। বিল্ডিং আছে কিন্তু ডাক্তার এবং কর্মী নেই, কোনো সরঞ্জাম নেই, যদি সরঞ্জাম পাওয়া যায় তবে এটি পরিচালনা করার জন্য কোনো প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কর্মী নেই। জনস্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবের ফলে রোগের উচ্চ প্রকোপ এবং শ্রমিকদের কম উৎপাদনশীলতা দেখা দেয়। ওপরের প্রতিটি সমস্যায় প্রশাসনিক সাফল্য এবং সরকারের ব্যর্থতার প্রশ্ন জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক এই চারটি মাত্রায় রাষ্ট্রক্ষমতা পরিমাপ করা যেতে পারে। কাজের সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত না হলে সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকাশ হয় না।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা ব্যাপক নয়। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধিও সীমিত। বাংলাদেশে জিডিপিতে করের অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এই অনুপাত এক দশক আগের তুলনায় অনেক কম এবং দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে কম। এ কারণে বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের পদও শূন্য রয়েছে। আবার এটাও সত্য, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের প্রতিটি শাখায় অনেক পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে আছে, যার সবগুলোই আর্থিক কারণে নেই। অফিসে থাকা কর্মীরা অনেক শূন্য পদের কারণে অনেক কাজের চাপে থাকে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা অদক্ষ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে জিডিপিতে করের অনুপাত এত কম কেন এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের অস্বাভাবিকভাবে বড় অনানুষ্ঠানিক খাতের দিকে ইঙ্গিত করতে হবে। কৃষি শ্রমিক বাদ দিলে দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় ৭৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এদের বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ করের আওতায় না এলেও সংগঠিত খাতে করের হার কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধনীদের সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দেশটির ধনী এবং কার্যত কর বা রাজস্ব আদায়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
দুর্বল কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা। তবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে সঠিকভাবে উন্নয়নের কাজ অব্যাহত রাখতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ আমাদের যাত্রা ও লক্ষ্য বহুদূর, ২০৪১ সালে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হতে চাই। এটাই এখন সবার লক্ষ্য।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *