এসব নৃশংসতা ও বর্বরতার শেষ কোথায়?


হীরেন পণ্ডিত: বরগুনায় নিজ বাড়িতে সাবেক ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও বুকে টেঁটা মেরে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা। হত্যার সময় বীভৎসভাবে হত্যার পর বুকের ওপর চড়ে নারকীয় উল্লাস করেছে হত্যাকারীরা, সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র বিবদমান দুই গ্রুপের চলমান বিরোধের জেরে এক সংঘর্ষের পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানান স্থানীয়রা।
নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলায় বড় বোনকে উত্ত্যক্তের পর ছোট বোনকে উত্ত্যক্তের পর ব্যর্থ হয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে এক বখাটে যুবকের বিরুদ্ধে। ঘটনাগুলো মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক এবং চরম নৃশংস। আমরা আজকাল প্রায়ই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের কারো কারো দ্বারা এমন নৃশংস আচরণ লক্ষ্য করি। সমাজে বিরাজমান সামাজিক অপরাধের ধরনগুলোর মধ্যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অন্যতম। অপরাধবিজ্ঞানীরা কিশোর অপরাধ ও বয়স্কদের অপরাধের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে বয়স এবং অপরাধের ধরনকে প্রাধান্য দিতেন এক সময়। কিন্তু এখনকার সময়ে অপরাধের ধরন ও মাত্রা বিবেচনায় পার্থক্য বের করা কঠিন। ফলে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক ও আইনগত করণীয় বিষয়কে নতুন করে ভাবতে হবে। আবার কিশোর গ্যাং এর অপরাধ নিয়েও ভাবতে হবে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত না হলে একজন ব্যক্তি নৃশংস আচরণে নিজেকে জড়াতে পারে না। ব্যক্তি যখন সমাজের বিভিন্ন অবস্থা ও ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে ব্যর্থ হয়, তখন তার মধ্যে একটি ভিন্ন অবস্থা তৈরি হয়। তখন ব্যক্তির মধ্যে অস্বাভাবিকতা জন্ম লাভ করে। ফলে ব্যক্তি যেকোনো অপরাধমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। নৃশংস আচরণকে কোনোভাবেই এ থেকে বাদ দেওয়া যায় না। সামাজের বিভিন্ন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারার ব্যর্থতা পরিবার ও সমাজ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
বাঙালি এক সময় উদার ও আবেগপ্রবণ জাতি হসেবে পরিচিত ছিলো। পরের উপকার করতে পারলে সে ধন্য হতো। এতদিন এটাই জেনে এসেছিলাম। দেখেও আসছিলাম। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখছি এর উল্টো চিত্র। এখন সহনশীলতা ও ধৈর্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শিক্ষার হার এত যে বাড়ছে, তাতে কী লাভ হচ্ছে? শিক্ষিত হয়ে আমরা আরও বর্বরতার দিকে ধাবিত হয়ে যাচ্ছি কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কোনো ধরনের শিক্ষাইতো আমাদের মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে না, বা কোনো কাজে লাগছে কিনা সে প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
মানুষকে একসময় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে গণ্য করা হতো, অন্যান্য প্রাণী বা সব কিছু থেকে আলাদা করা হতো বিচার বুদ্ধির জন্য, বিবেকের জন্য। কিন্তু মানুষের কি বিচার-বুদ্ধি আছে এখন, মানুষকে কি বিবেককে কাজে লাগায়? মানুষের প্রতিদিন কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন, বিবেকের স্খলন হচ্ছে তা মানুষ কি ভেবে দেখে? মানুষের কাছে থাকা মানবীয় গুণাবলি বিসর্জন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের নীতি- নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে মানুষের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা।
মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে, প্রেম-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মাঝ থেকে। মানুষ কিন্তু মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে ক্রমেই মানুষ হিসেবে নয়, ক্রমেই হিং¯্র প্রাণীর মতো নিষ্ঠুর আচরণ করছে। এমন কেন হচ্ছে? সময়ের আবর্তনে সভ্য মানুষ হিসেবে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ যেখানে বৃদ্ধি পাবার কথা, সেখানে মানবতবোধ কমছে, প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলি আরও বেশি থাকার কথা, তা কিন্তু এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। আজকাল প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টালেই নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মা নিজের হাতে তার সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যা করছে। বাবার লাঠি বা অস্ত্রের আঘাতে পুত্র মৃত্যুবরণ করছে। স্বাধীন জীবন-যাপনের জন্য মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করছে, ছেলে জন্মদাতা পিতা-মাতাকে হত্যা করছে। সামান্য জমি বা টাকার জন্য ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা মাতাকে হত্যা করছে।
ভালো-মন্দের বিচারক্ষমতা দ্বারা যে বিবেক নির্ধারিত হয় সে ব্যাপারে সকলেই একই বিন্দুতে থাকবেন নিঃসন্দেহে তা বলা সম্ভব, ভিন্ন বিন্দুতে থাকবেন ভালো-মন্দ আলাদা করা নিয়ে অর্থাৎ কোনটা ভালো ও কোনটা মন্দ সেটা নির্ধারণে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে। এ ভিন্নতা হতে পারে ব্যক্তি, সমাজ, এলাকা, সময়, ঘটনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। বিবেকের কাজ হলো কোনো কিছুর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সক্ষমতা-অক্ষমতা, নীতির কাছে সঁপে দিয়ে বর্তমানকে ভিত্তি ধরে ভবিষ্যৎ ভাবনাকে বিচার করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানবসত্তাকে সহযোগিতা করা, কিন্তু আসল সিদ্ধান্তে আসতে হবে সত্তা নিজেকেই। আমরা প্রত্যেকেই দশের শান্তির কথা বলি, মিলনের কথা বলি, উজ্জ্বলতার কথা বলি, নীতির কথা বলি, সত্যের কথা বলি, সাফল্যের কথা বলি এমনকি এসব কথা শুনতেও পছন্দ করি; কাজের বেলায়ও এসবের জন্য নিজেকে সঁপে দিতে ভালো লাগে, কিন্তু যখন দেখা যায়- দশের তুলনায় নিজের থলেটা তেমনভাবে পূর্ণ হচ্ছে না; তখনই বিবেক হয়ে ওঠে হিং¯্র। আর যে শান্তি কিংবা অন্য ইতিবাচক কিছুর জন্য নিজেকে তুলে ধরা হয়েছিল, সেসব কিছু একটি অসুস্থ বিবেক এসে ঢেকে ফেলে।
কিন্তু, আমরা কি বিবেক নিয়ে ভাবি? এখন আমরা ব্যস্ত আছি কে কতটা নীচে নামতে পারি সেই প্রতিযোগিতায়। কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন হচ্ছে প্রতিদিন তা আমরা ভেবে দেখি না, জীবনযাত্রার দৌড়ে সবাই শামিল কে কাকে কীভাবে পেছনে ফেলে নিজে এগিয়ে যাবে তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, বিবেকের স্খলন হচ্ছে তা আমাদের কাছে যেন কোনো ব্যাপারই নয়। যেকোনো মূল্যে সম্পদশালী হতে হবে। আমাদের কাছে থাকা মানবীয় গুণাবলি বিসর্জন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত, সম্পদ আহরণের জন্য, ভোগ বিলাসের জন্য। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নীতি নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা।
চারদিকে শুধু হত্যা ও জিঘাংসা মানুষকে অন্ধ করে ফেলছে। মানুষের মনে শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণতা, টাকা উপার্জনের চেষ্টা, সন্তান, পরিবার-পরিজন কে কোথায় কী করছে, এত কিছু ভাবার সময় নেই। সন্তান, পরিবার-পরিজন ইতিবাচক ভূমিকা পালন না করলে, শুধু টাকা দিয়ে কিছু হবে না এই উপলব্ধি আমরা করতে পারছি না। সামান্য বিষয়ে খুন-খারাবি একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এমনতো হবার কথা ছিল না। বাঙালি জাতির সহভাগিতা ও সহমর্মিতার গল্প অনেক পুরানো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি, একজন আহত যোদ্ধাকে বাঁচাতে মানুষের সে কী ব্যাকুলতা! সেই ব্যাকুলতা সহমর্মিতা ও সহভাগিতা আজ কোথায় হারিয়ে গেল বা হারিয়ে যাচ্ছে? সব মৃত্যুই বেদনার, সব কষ্টই কষ্ট, তারপরও কেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতির এভাবে মনুষ্যত্বের অধঃপতন, নৈতিক স্খলন, তা কখনও মেনে নেয়া যায় না। তার পরও কোনো কোনো ঘটনা আছে বা কোনো মৃত্যু আছে বুকের পাঁজর ভেঙে চুরমার করে দেয়। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে সামান্য ঝগড়া। আর তাতেই প্রাণ গেল আরেক বন্ধুর। সামান্য ঝগড়ার জন্য নির্মমভাবে হত্যা করে প্রতিবেশী। আপন চাচা হত্যা করছে নিজের ভাতিজাকে।
আমাদের মধ্যে এমন পশুপ্রবৃত্তি বাড়ছে কেন? এই যে সামাজিক অস্থিরতা চলছে এর শেষ কোথায়? মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু আইনি কাঠামো দিয়ে এ অবক্ষয় দূর করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক আন্দোলন এবং নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ এতটাই নিম্নগামী হয়েছে যে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য শিশুর মতো পবিত্র নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নিতেও দ্বিধা করছি না। কেন এমন হলো?
দিনে দিনে আমরা আরও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কোনো ধরনের শিক্ষাই আমাদের মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা ক্রমেই আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি। ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবা জরুরি। একবার খাদের কিনার থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেলে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানো জাতির জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এমন সব কারণে আমাদের সমাজে মেধাবী কম না হলেও আদর্শনিষ্ঠ এবং সৎ ও নীতিপরায়ণ মেধাবী প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে।
আসুন, আমরা শিশু-কিশোরদের এমন একটি পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ উপহার দেই যেখানে অনেকের পক্ষে নিজেকে সুন্দরভাবে তৈরি করা কিংবা খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ হয়। তখন তাদের মধ্যে তৈরি হবেনা মানসিক বিকারগ্রস্ততা ও হতাশা, যা তাকে বাধ্য করবে না হত্যার মতো নৃশংস আচরণ করতে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এমন মনোজগৎ তৈরি হওয়ার পেছনে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর ভূমিকাও অনেক। কেননা বিদ্যমান অবস্থার কারণে সমাজে প্রচলিত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অপরাধ প্রতিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অনেকের মধ্যেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে যায়। অপরাধ এবং একে কেন্দ্র করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নতুন কোনো অপরাধ করা থেকে বিরত রাখার কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারছে না। পরিবারকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বিবেচনা করে আসছি। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে আরো অনেক কিছু এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনের মতো সম্পর্কগুলোকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এগিয়ে যেতে হবে।
এই সব নৃশংসতা ও বর্বর আচরণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয় বর্তমান সময়ে আমাদের বড় সংকট পারিবারিক সম্পর্কের পরিচর্যা না করা। আমরা অনেক কিছুর পরিচর্যা করি, কিন্তু সম্পর্কের পরিচর্যার প্রতি আমরা যেন উদাসীন। সম্পর্কের পরিচর্যার অভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য নিজেকে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে কিংবা পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিশু-কিশোররা ব্যর্থ হয়। তখন তাদের মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ততা তৈরি হয়। নিজেকে সঁপে দেয় নেশার জগতে কিংবা নৃশংস কোনো অপরাধমূলক কাজে।
আসুন, আমরা আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করে আমাদের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে বাংলাদেশেকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। যে জন্য ৩০ লাখ শহিদ আত্মত্যাগ করেছেন, অসংখ্য মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা মনোনিবেশ করি, আমরাই একটি সুন্দর সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *