হীরেন পণ্ডিত
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির সুফল যাতে সবাই পায়, সে জন্য তার ন্যায্য বণ্টন আশা করেন, যাতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জিত হয়। ‘আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ো তুলছি যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলতে পারে এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাবিøউইএফ) আয়োজিত ‘নিউ ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি ইন স্মার্ট বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামগুলো মানবতাকে আঘাত করে বা ক্ষুণœ করে, এমন কাজে ব্যবহার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের সমাজের মধ্যে আরো বিভাজন তৈরি করবে না। এই উদ্দেশ্যে আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বানের মধ্যে অন্তর্নিহিত বার্তাটি হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রসর প্রযুক্তি; যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানবতাকে বিপন্ন করার জন্য নয়, বরং তা যেন মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। তিনিও সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন কমাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রসর (ফ্রন্টিয়ার) প্রযুক্তি উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করলেও তা দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে মানব অস্তিত্ব ও মানবতাকে আঘাত করার কাজে ব্যবহার থেকে রাষ্ট্রগুলোকে নিবৃত্ত করানো। দ্বিতীয়ত, দেশ ও সমাজের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন ও বৈষম্য হ্রাসে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন হস্তান্তর বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশীদারি গড়ে তোলায় উদ্ভাবক দেশ ও ধনী দেশগুলোকে সম্মত করানো। এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে দু’টি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। প্রযুক্তি যেন মানুষের কল্যাণেই ব্যবহৃত হয় এবং তা যেন সমাজে ডিজিটাল বিভাজন বা বৈষম্য তৈরি না করে।
আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিদ্যমান বিশ্ব বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করি, তাহলে তাঁর প্রথমোক্ত বিষয়ে উদ্বেগ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে সাইবারজগতের যুদ্ধ নিয়ে দি ইকোনমিস্টের ২০১০ সালের ১ জুলাই ‘দ্য ওয়ার ইন দ্য ফিফথ ডোমেইন’ শিরোনামের প্রতিবেদনের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। প্রতিবেদনে বলা হয়, জল, স্থল, আকাশ ও মহাকাশ এই চার ডোমেইনে (ক্ষেত্র) যুদ্ধের পর বর্তমানে বিশ্বে আরেকটি ক্ষেত্রে যুদ্ধ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে সাইবার ওয়ার্ল্ডের যুদ্ধ। ১৯৮২ সালের কথা। স্নায়ুযুদ্ধ তখন নতুন উচ্চতায়। আমেরিকার আগাম সতর্কতার স্যাটেলাইট সাইবেরিয়ায় একটি বিস্ফোরণের ঘটনা চিহ্নিত করে। পত্রিকাটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সোভিয়েত গোয়েন্দারা কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি চুরি করে। তারা জানত না যে সিআইএ তা আগেই টেম্পারড করে রেখেছিল। সোভিয়েত গ্যাস পাইপলাইনে তা বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরিত হয়। এটি ছিল নন-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ব্যবহার করে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা। সেই থেকে এ যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রকে কেউ কেউ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করছে। এ ঘটনার ২৩ বছর পর সাম্পতিক উদ্বেগজনক খবরটি হলো মার্কিন সেনাবাহিনী এরই মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে স্পষ্টত প্রতিভাত হয়। গুগলের ডিপমাইন্ড, ওপেন এআই চ্যাটজিপিটি ও এআই স্টার্টআপ অ্যানথ্রপিকের প্রধান নির্বাহীরা শত শত স্বাক্ষরদাতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানব অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই বলেছেন, এআই প্রযুক্তি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নজরদারি, মারণাস্ত্র কিংবা ভুয়া খবর ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তাঁর দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে এর অনেক উপযোগিতা রয়েছে। স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান ইলন মাক্স সতর্ক করে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পারমাণবিক অস্ত্রেও চেয়েও বিপজ্জনক হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কার জায়গাটি কোথায়, তা বিশ্বের খ্যাতনামা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। আমাদের দেশেও কি প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে না? একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক স্বার্থে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ছদ্ম সত্য ঘটনা তৈরির পাশাপাশি ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করছে। এ ধরনের তৎপরতা আসলে মানবতার বিপক্ষেই পরিচালিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই বছর ধরে এআই অ্যাক্টের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশও এআই আইন প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বাংলাদেশ’ প্রণয়ন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন যেন গুটিকয়েক উদ্ভাবক দেশের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এটি হলে ডিজিটাল বিভাজন ও বৈষম্য তৈরি হবে। ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হতে পারে দুইভাবে। উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন অন্য দেশে হস্তস্তান্তর করা না হলে তা দেশগুলোর মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করবে। এতে ধনী দেশগুলো আরো ধনী হবে; দ্বিতীয়ত, উন্নত প্রযুক্তিবঞ্চিত দেশগুলোর জন্য ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, জাতি-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে তা সমাজে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করবে।
তবে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রযুক্তিমনস্ক সরকার ক্ষমতায়, যারা ১৫ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জাতিসংঘ ঘোষিত ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’ অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনায় নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করছে। বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি সহযোগিতা না পেলেও একেবারেই নিজস্ব পরিকল্পনায় বটম আপ অ্যাপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের একজন নাগরিকের চার কিলোমিটার দূরত্বে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করে সরকার, যার লক্ষ্য তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনা। এর ফলে একজন নাগরিকের সেবা পেতে ৬৫ শতাংশ এবং খরচ ৭৩ শতাংশ হারে হ্রাস পায়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মসূচিতে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে গ্রামে। তখন গ্রামের মানুষেরও আইসিটিতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হবে। শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজনও একেবারেই কমে আসবে এমন আশা দেখাচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ মাস্টারপ্ল্যান প্রণেতারা।
হীরেন পÐিত
প্রযুুক্তি যেন ক্ষতির কারণ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির সুফল যাতে সবাই পায়, সে জন্য তার ন্যায্য বণ্টন আশা করেন, যাতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জিত হয়। ‘আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ো তুলছি যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলতে পারে এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাবিøউইএফ) আয়োজিত ‘নিউ ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি ইন স্মার্ট বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামগুলো মানবতাকে আঘাত করে বা ক্ষুণœ করে, এমন কাজে ব্যবহার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের সমাজের মধ্যে আরো বিভাজন তৈরি করবে না। এই উদ্দেশ্যে আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বানের মধ্যে অন্তর্নিহিত বার্তাটি হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রসর প্রযুক্তি; যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানবতাকে বিপন্ন করার জন্য নয়, বরং তা যেন মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। তিনিও সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন কমাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রসর (ফ্রন্টিয়ার) প্রযুক্তি উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করলেও তা দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে মানব অস্তিত্ব ও মানবতাকে আঘাত করার কাজে ব্যবহার থেকে রাষ্ট্রগুলোকে নিবৃত্ত করানো। দ্বিতীয়ত, দেশ ও সমাজের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন ও বৈষম্য হ্রাসে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন হস্তান্তর বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশীদারি গড়ে তোলায় উদ্ভাবক দেশ ও ধনী দেশগুলোকে সম্মত করানো। এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে দু’টি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। প্রযুক্তি যেন মানুষের কল্যাণেই ব্যবহৃত হয় এবং তা যেন সমাজে ডিজিটাল বিভাজন বা বৈষম্য তৈরি না করে।
আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিদ্যমান বিশ্ব বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করি, তাহলে তাঁর প্রথমোক্ত বিষয়ে উদ্বেগ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে সাইবারজগতের যুদ্ধ নিয়ে দি ইকোনমিস্টের ২০১০ সালের ১ জুলাই ‘দ্য ওয়ার ইন দ্য ফিফথ ডোমেইন’ শিরোনামের প্রতিবেদনের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। প্রতিবেদনে বলা হয়, জল, স্থল, আকাশ ও মহাকাশ এই চার ডোমেইনে (ক্ষেত্র) যুদ্ধের পর বর্তমানে বিশ্বে আরেকটি ক্ষেত্রে যুদ্ধ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে সাইবার ওয়ার্ল্ডের যুদ্ধ। ১৯৮২ সালের কথা। স্নায়ুযুদ্ধ তখন নতুন উচ্চতায়। আমেরিকার আগাম সতর্কতার স্যাটেলাইট সাইবেরিয়ায় একটি বিস্ফোরণের ঘটনা চিহ্নিত করে। পত্রিকাটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সোভিয়েত গোয়েন্দারা কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি চুরি করে। তারা জানত না যে সিআইএ তা আগেই টেম্পারড করে রেখেছিল। সোভিয়েত গ্যাস পাইপলাইনে তা বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরিত হয়। এটি ছিল নন-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ব্যবহার করে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা। সেই থেকে এ যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রকে কেউ কেউ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করছে। এ ঘটনার ২৩ বছর পর সাম্পতিক উদ্বেগজনক খবরটি হলো মার্কিন সেনাবাহিনী এরই মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে স্পষ্টত প্রতিভাত হয়। গুগলের ডিপমাইন্ড, ওপেন এআই চ্যাটজিপিটি ও এআই স্টার্টআপ অ্যানথ্রপিকের প্রধান নির্বাহীরা শত শত স্বাক্ষরদাতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানব অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই বলেছেন, এআই প্রযুক্তি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নজরদারি, মারণাস্ত্র কিংবা ভুয়া খবর ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তাঁর দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে এর অনেক উপযোগিতা রয়েছে। স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান ইলন মাক্স সতর্ক করে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পারমাণবিক অস্ত্রেও চেয়েও বিপজ্জনক হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কার জায়গাটি কোথায়, তা বিশ্বের খ্যাতনামা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। আমাদের দেশেও কি প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে না? একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক স্বার্থে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ছদ্ম সত্য ঘটনা তৈরির পাশাপাশি ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করছে। এ ধরনের তৎপরতা আসলে মানবতার বিপক্ষেই পরিচালিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই বছর ধরে এআই অ্যাক্টের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশও এআই আইন প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বাংলাদেশ’ প্রণয়ন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন যেন গুটিকয়েক উদ্ভাবক দেশের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এটি হলে ডিজিটাল বিভাজন ও বৈষম্য তৈরি হবে। ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হতে পারে দুইভাবে। উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন অন্য দেশে হস্তস্তান্তর করা না হলে তা দেশগুলোর মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করবে। এতে ধনী দেশগুলো আরো ধনী হবে; দ্বিতীয়ত, উন্নত প্রযুক্তিবঞ্চিত দেশগুলোর জন্য ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, জাতি-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে তা সমাজে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করবে।
তবে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রযুক্তিমনস্ক সরকার ক্ষমতায়, যারা ১৫ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জাতিসংঘ ঘোষিত ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’ অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনায় নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করছে। বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি সহযোগিতা না পেলেও একেবারেই নিজস্ব পরিকল্পনায় বটম আপ অ্যাপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের একজন নাগরিকের চার কিলোমিটার দূরত্বে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করে সরকার, যার লক্ষ্য তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনা। এর ফলে একজন নাগরিকের সেবা পেতে ৬৫ শতাংশ এবং খরচ ৭৩ শতাংশ হারে হ্রাস পায়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মসূচিতে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে গ্রামে। তখন গ্রামের মানুষেরও আইসিটিতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হবে। শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজনও একেবারেই কমে আসবে এমন আশা দেখাচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ মাস্টারপ্ল্যান প্রণেতারা।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক