হীরেন পণ্ডিত: বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্প বিল্পব, দ্বিতীয় শিল্প বিল্পব শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে, তৃতীয় শিল্প বিল্পব শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, বায়ো টেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিলনে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিল্পব। এই শিল্প বিল্পব মোকাবেলায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা শ্রমজীবীদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে প্রয়োজন হয় গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের। এ প্রশিক্ষনের প্রথম ধাপ শুরু হয় শিক্ষা গ্রহণের প্রথম থেকে। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মীতে রূপান্তর হয় এবং উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে কর্মী সম্পদে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম জনশক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য গুনগত মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন এবং আরো প্রয়োজন সরকারী প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যাক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা।
বর্তমান পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পণ্য উৎপাদন, অপারেশন থিয়েটার এর কাজ ও আইনি সেবা পর্যন্ত দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতির কতটুকু দেখতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় জায়ান্টরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্যের বা সেবায় উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়েছে ও পণ্যের গুণগত মান উন্নত করেছে। এতে করে তাদের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি বহুগুণে বেড়েছে প্রবৃদ্ধি।
আমাদের কারিগরি শিক্ষা ও বিশ্ব প্রস্তুতিতে দেখা যায়, জার্মানিতে ১৯৬৯ সালে, সিঙ্গাপুরে ১৯৬০ সালে ও বাংলাদেশে ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছে। অন্যান্য দেশগুলি দ্রæত উন্নতি করলেও আমরা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে কারিগরি শিক্ষার হার ও গুণগত মানের দিক দিয়ে অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী আমাদেও দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮ হাজার ৬৭৫ টি। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়াশোনা করছে।
কারিগরি শিক্ষার হারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছ। আমাদের মাত্র ১৪% শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে যেখানে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার জার্মানিতে ৭৩ শতাংশ, জাপান ৬৬ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ৬৫ শতাংশ, অষ্ট্রেলিয়া ৬০ শতাংশ, চীন ৫৫ শতাংশ,দক্ষিণ কোরিয়া ৫০ শতাংশ, মালেশিয়া ৪৬ শতাংশ। অবশ্য আমাদের বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে একটি দীর্ঘ ময়োদী লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে যা ২০২০ সালে ২০% , ২০৩০ সালে ৩০% এবং ২০৫০ সাল নাগাদ কারিগরি শিক্ষার হার ৫০% এ উন্নীত করার এই লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে বাংলাদশে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
শিল্প কলকারখানা ও অফিসে এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০ বছর অনেক পেশা হারিয়ে যাবে এবং তৈরি হবে নতুন কর্মক্ষেত্র। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০ কোটি শ্রমকি বর্তমান চাকুরি হারাবে। স্বভাবত আমাদের মতো শ্রম নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। আমাদের দক্ষতাবিহীন সনদভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাড়াবে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের এই কথায় জানান দেয়। প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ তরুণী বেকারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।
বর্তমানে আমাদেরকে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষাকে বিস্তৃত করতে হবে। এখনকার প্রতিষ্ঠিত সকল উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে পূর্ণগঠন করতে হবে। অন্যথায় দেশের শ্রমবাজার আয় বৈষম্য তৈরি হবে। মুষ্টিমেয় কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন লোক অনেক বেশি আয় করবে আর অন্য শ্রমজীবীরা জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় আয়ের ব্যবস্থা করতে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হবে।
সরকার দেশের দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আর এখানে প্রচুর কারিগরি ভাবে দক্ষ শ্রমিকরে প্রয়োজন হচ্ছে। এই সঙ্গে রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরকে বিদেশে পাঠানোর আগে যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদের রমেটিন্সে প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ। যা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
তাই আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ও হাইটেক পার্কসহ সবাইকে এক হয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয়টি মনেপ্রাণে অনুধাবন র্পূবক কারগিরি শক্ষিার উন্নয়নরে জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সরকারকে এ খাতে উন্নয়ন বাজেট বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদরেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হেলথকেয়ার, লজিস্টিকস এবং ওয়্যারহাউজিং, অটোমটিভ এবং কিছু সেবাখাত এরই মধ্যে তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এআই ব্যবহার করছে। এছাড়া কিছু নন-ট্র্যাডিশনাল খাত যেমন; ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস, কনস্ট্রাকশন, প্লাস্টিক এবং প্যাকেজিং, এফএমসিজি, ডিফেন্স এবং সিকিউরিটি, ফার্নিচার শিল্প এরই মধ্যে এআই সহায়ক রোবট ব্যবহার করছে।
এসব খাত তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে, নির্ভুলতা বা প্রিসিসন, রিপিটিটিভ উৎপাদনে সময় কমিয়ে আনার জন্য এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারে বাড়তি বিনিয়োগ করছে। সর্বোপরি রফতানি সক্ষমতা এবং ক্রেতার নির্দেশনা মেনে চলতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু বর্তমানে তাদের জন্য অনেকটা বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে।
উন্নততর প্রযুক্তি গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন বিশেষভাবে জরুরি। ফাইভজি নেটওয়ার্কের গুরুত্বের বিষয়ে বলা হচ্ছে তবে ফাইভজি কাভারেজের আগে আমাদের ফোরজি নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তার জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি সবচেয়ে জরুরি এবং আমাদের প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী কানেক্টিভিটি, যা ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে জরুরি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের হাই-টেক ও আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষমতা রয়েছে। রোবোটিকস খাতের বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় বাংলাদেশ রোবোটিকস অ্যাসেম্বলিং খাতে মনোনিবেশ করতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং হাই-এন্ড প্রোগ্রামিং প্রযুক্তির বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পড়াশোনার কাজে ৯৪.১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও পড়াশোনার ফাঁকে অনলাইনে প্রবেশ করলে ৫২.৬ শতাংশের মনোযোগ হারিয়ে যায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী আসক্তি অনুভব করে। ৩০.৪ শতাংশ ঘুম না হওয়ার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকে পুরোপুরিভাবে দায়ী করেছে। আচরণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর ধৈর্যশক্তির হ্রাস ঘটার তথ্য এসেছে।
স্কুল ইন ক্লাউডে প্রথমে একটি স্কুলকে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে এসে এখানে ভালো ভালো শিক্ষকের লেকচার আপলোড করা যেতে পারে। এই লেকচারগুলো অন্য শিক্ষকরা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সেগুলো তারা ব্যবহার করতে পারেন অথবা তারা নতুন করে তৈরি করতে পারেন। এই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটি কীভাবে ব্যবহার করা হবে তাও এর মধ্যে থাকবে। এর ফলে খুব সহজে অনেক বেশি শিক্ষককে এই স্কুল ইন ক্লাউডের মাধ্যমে সংযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরাও জড়িত থাকবে। তারা লেকচারগুলো দেখবে, তাদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবে, অন্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করবে। আমরা যদি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে স্কুল ইন ক্লাউড, কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউডে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারি, তাহলে দেশের সব শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। মোটকথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আগামী প্রজন্ম স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। শিক্ষা বিভাগকে কম গুরুত্ব দিয়ে স্মার্ট নাগরিক তৈরির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। সে কারণে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে চাই স্মার্ট স্কুল।
স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ ক্লাউডনির্ভর। এখানে কোনো ধরনের হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হবে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, স্কুল ইন ক্লাউড, দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং তৃতীয়ত, রিজিওয়াল স্কুল ইন ক্লাউড। এগুলোর প্রতিটি একেকটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটিকে ট্রেনিং টুল হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে ট্রেনিংয়ের বিষয়গুলো থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শিখতে পারবে।