হীরেন পণ্ডিত: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দরিদ্র ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষা প্রদানের জন্য নিজ পরিবারসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করতেন। তিনি অনেক ছাত্রের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তিনি নিজ আদর্শ এবং দেশের মানুষের কল্যাণের মহান ব্রত থেকে সরে যাননি কখনো। অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামে রাজনীতি করা অনেক সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এখন নিজেদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। বিভিন্ন অপকর্ম করে মিডিয়ায় আসেন দল ও নেতাকর্মীরা, বিব্রত হন সরকার, বিব্রত হয় দেশ-জাতি। বিপথগামী নেতাকর্মীরা এমন কাজ থেকে বিরত থাকবেন এই প্রত্যাশা সবার।
বাঙালি জাতির পিতার আদর্শের রাজনীতির বাহক হবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং দলমত নির্বিশেষে দেশের তরুণরা। তারা দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতোই নিঃস্বার্থে কাজ করবে, অহঙ্কারমুক্ত থাকবে, মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ না করে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতের মাধ্যমে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়বে।
আমাদের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের যারা নেতাকর্মী আছেন, একেবারে ওপরে থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের বেশ কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঠিকমতো বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও তারা তাদের নিজস্ব বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে ইচ্ছেমতো চলেন। যার জন্য দেখা যায় দেশব্যাপী সত্যিকারের দলের বা সরকারের কাজ যা করা দরকার, অনেকেই তা করছেন না। নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে কাজ করার প্রবণতায় ঘাটতি দেখা যায়। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিত পথে শেখ হাসিনার নির্দেশে সবাইকে কাজ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের এমন অনেক নেতা আছেন যারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না আবার অনেক সময় বিব্রতকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনে যারা নেতৃত্বে আছেন তারা নেত্রীর যে দর্শন, বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন সেই দর্শনকে বাস্তবায়িত করবেন। নেত্রী যে কাজ দিয়েছেন সেগুলো জনগণকে জানাবেন এবং কাজের মাধ্যমে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেবেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের ছাত্রসমাজকে নিয়ে ভাবতেন এবং তিনি বলতেন, ‘ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারাই হয়ে উঠবে এক আদর্শবান শক্তি। এই আদর্শ মানুষ বলতে তিনি এমন ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন, যে উন্নত মানবিক গুণাবলি ধারণ করবে ও অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য হবে।’ অর্থাৎ সামাজিকভাবে যা কিছু ভালো-শ্রেষ্ঠ, মহৎ ও কল্যাণকর সবকিছুই থাকবে ছাত্রসমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে। আদর্শ মানুষ হতে হলে সবার ভেতর যেসব গুণ থাকা দরকার সেগুলো হলো-সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমী ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন একজন আদর্শবাদী মানুষ। বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, এখনও রাখছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষ্যে ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মী রাজপথে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে যেমন হাজার হাজার যোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে তেমনই কিছু সংখ্যক অযোগ্য নেতাকর্মীরও জন্ম হয়েছে। যার কারণে মাঝেমধ্যে বিতর্কিত হতে হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠনটিকে।
কিছু সংখ্যক সুযোগসন্ধানী ও হাতেগোনা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের বিপথগামী সমর্থকদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা সামনে চলে আসছে। এসবই অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এমনটি আমাদের আশাবাদের জায়গাকে হতাশায় ভরে দেয়। ছাত্রলীগের প্রতাপশালীদের দুয়েকজনের সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিপথগামীদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ এসবের মধ্যে তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো বিতর্কিত করে ফেলছে।
অতীতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের অস্থিরতার এক পর্যায়ে তাদের লাগাম টেনে ধরতে কঠোর অবস্থান নিয়ে অপকর্মে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। মনে করা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে বিপথগামীদের আত্মোপলব্ধি হবে এবং সংগঠনের নেতাকর্মীরা সব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে শামিল হবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এরপরও বিপথগামীরা যে অবস্থায় ছিল সেখানেই রয়ে গেছে এবং বিতর্ক যেন ক্রমেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে। ফলে সরকার একদিকে দেশকে উন্নয়নের অনেক সূচকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে যখন বিশ্বের অনেক দেশ ও সংস্থার প্রশংসা অর্জন করেছে, একই সঙ্গে বিপরীত কিছু সংখ্যক বিপথগামীদের কারণে দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিল তিল করে গত এক দশকে দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে এবং ভিশন ২০২১ অর্জনের পর ভিশন ২০৪১ বা স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনে দৃঢ় নেতৃত্বে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, অপরাধীদের পরিচয় একটাই তারা অপরাধী। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং কতিপয় হীনস্বার্থবাদীর অপচেষ্টা, যারা ব্যক্তিগতভাবে সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারের অনেক ভালো কাজ চাপা পড়ে যাচ্ছে, যা নিয়ে হীনস্বার্থবাদীরা মোটেও চিন্তিত নয়।
এসব ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক অস্থিরতা, অসাধু ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনো ধরনের লোমহর্ষক অপরাধ যাতে না ঘটতে পারে সে জন্য জেলা পুলিশ সুপারদেরও প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কোনো জেলায় লোমহর্ষক অপরাধ ঘটলে সেগুলোর রহস্য উন্মোচন ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে জেলার এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে বলেও হুঁশিয়ারি জানিয়ে বার্তা দিয়েছে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
লোমহর্ষক অপরাধ বৃদ্ধির নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেন লোমহর্ষক অপরাধ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু সামাজিক অস্থিরতাকে প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে বলা ঠিক হবে না; বরং এর সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে আমরা খুব অস্থির সময় পার করছি। এখানে আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির ব্যবহার, ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক বিষয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাবে আমাদের জীবনধারার পথ পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের হাতে টাকা-পয়সা এসেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে; ফলে আমরা এক ধরনের ফ্যান্টাসির মধ্যে আছি। আমাদের প্রথাগত সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে যাওয়ার যুগসন্ধিক্ষণে অনেক বিষয় অনুপ্রবেশ করছে। এগুলোর একটা প্রভাব পড়ছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও লোভ বেড়েছে। অপরাধ বৃদ্ধিতে মাদকেরও বড় একটা প্রভাব আছে।
এখন সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে। ত্যাগীরা ব্যাকফুটে, তাই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যদি বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো না হয়, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেছেন। অনেক মানুষ আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছে-যারা রাজনৈতিক কর্মী নয়; তারা দলছুট ও সুবিধাভোগী। তারা তোষামোদ ও বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে রাজনীতি করছে। তাদের চিহ্নিত করতে না পারলে এবং তাদের গতিবিধি সঙ্কুচিত করতে না পারলে সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব অপরাধ বৃদ্ধির কারণ ক্ষমতার দম্ভ এবং অপরাধীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। তবে তাদের মতে সীমিত পরিসরে এর বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।
তৃণমূলের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের বদনামের পেছনে আজেবাজে লোক দলে ঢুকে পড়ছে বলে প্রধানমন্ত্রী এক সভায় সতর্ক করেছেন নেতাদের। এক সভায় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় বড় সংগঠন হওয়ার সুযোগে অনেক ‘আলতুফালতু’ লোক সংগঠনে ঢুকে অপরাধ করে দলের বদনাম ডেকে আনছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব নেতিবাচক খবর আসে এমন বাস্তবতায় সবাইকে আরও সাবধান থাকতে বলেন। কারণ বদনামটা দলের ওপর পড়ে। সংগঠন করার সময় নিজেদের বদনাম, দলের বদনাম, দেশের বদনাম না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বর্তমানে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রশ্নে মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির প্রবেশগম্যতাকে ব্যবহার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক এই রূপান্তরের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায়ও রূপান্তর প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নেতাকর্মীদের মধ্যে থাকবে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে একজন আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। আগামী দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় কাজ করে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে-এটাই সবার প্রত্যাশা।