প্রাকৃতিক দুর্যোগ নারীর জন্য আরেক দুর্ভোগ

হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। সারা বছরের বিভিন্ন সময়ে ঝড়, বন্যা,
জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের
কবলে পড়তে হয়, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ভবিষ্যতেও আরও নানা ধরনের
দুর্যোগের আশঙ্কাও রয়েছে। এসব নানারকম দুর্যোগের কারণে নারীরা সবচেয়ে
বেশি দুর্ভোগের শিকার হন। যাতে নারীদের আর ভোগান্তিতে না পড়তে হয়, তা
দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের সর্বোপরি সরকারের। এরপর বাকি সবার। তবে সরকার যে
একবারে কোন উদ্যোগ নেয় না, তা নয়। সরকার দুর্যোগে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক
নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নারীরা যাতে দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা
করতে পারে, তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন জরিপের ফলাফলে দেখা
গেছে, যাতায়াতসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীরা
পুরুষের তুলনায় ২৪ শতাংশ কম সক্ষমতাসম্পন্ন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, অবকাঠামো ও
প্রাতিষ্ঠানিক সূচকে নারীর স্কোর ৪০ আর পুরুষের স্কোর ৫৫। কাজেই দেখা যায়,
দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীকে সক্ষমতাসম্পন্ন করতে হলে সরকারকে আরও কার্যকর
উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে নারীবান্ধব করতে হবে। এ
ক্ষেত্রে নারীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে দুর্যোগে
নারীর দুর্ভোগ কিছুতেই কমবে না বরং বাড়বে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে
আবালবৃদ্ধবনিতা সবার সমান দুর্ভোগ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নারীর দুর্ভোগ
বেশি। আর সে নারী যদি হয় শিশু-কিশোরী-তরুণী-মা। যখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে
জেন্ডার ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটেনি, তখন দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য
যে ব্যবস্থা নেয়া হতো, সেখানে নারীর সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি সম্পূর্ণ
অনুপস্থিত থাকত। শুরুর দিকে দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কোন শৌচাগারের
ব্যবস্থা করা হতো না, যেন ধরেই নেয়া হতো গরিবের আর ঘোড়ারোগ ধরিয়ে লাভ কী।
তারা তো মাঠেঘাটেই প্রাকৃতিক কর্মটি করে থাকেন। পরে এ কারণে যখন দূষিত
পানিবাহিত রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন সেবা সংস্থাগুলোর টনক
নড়ল। এক সময় শৌচাগারের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু দেখা গেল, সেগুলো নির্মাণ করা
হয়েছে পুরুষের ব্যবহারের উপযোগী করে। অর্থাৎ একদিক খোলা রেখে। নারীরা তাদের
শাড়ি-ছায়া ঝুলিয়ে কোনো রকমে তা ব্যবহার করতেন। তারপর উন্নয়ন নীতিমালায়
জেন্ডার সমতার অন্তর্ভুক্তি, অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান সুযোগের
অধিকার নিশ্চিত করার দাবি সোচ্চার হলো। এর মাধ্যমে জেন্ডার ভূমিকা ও চাহিদা
স্পষ্ট হলে নারীর পৃথক শারীরিক কাঠামো ও পরিবর্তনকে আমলে নেয়া হয়। কিন্তু
গরিব দেশের আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণসামগ্রী এখনও নারীবান্ধব নয়।

বন্যায়
বাড়িঘর-উঠোন-পায়খানা-পুকুর-ডোবা সব একাকার। কিন্তু জীবনচক্র থেমে নেই। পানি
থইথই করা ঘরের মধ্যে চৌকির ওপর নারী প্রথম সন্তান জন্ম দেয়। সে সময় বাড়িতে
কোন পুরুষ না থাকায় কোনমতে রাত কাটিয়ে মা ও ভাবির সহায়তায় নারী নবজাতককে
নিয়ে নৌকা করে সড়কে গিয়ে ওঠেন। সেখানে পলিথিনের ছাপরা বানিয়ে শুরু হয় তাদের
ভোগান্তির জীবন। সে ভোগান্তি বর্ণনা করার মতো নয়। ঋতুকালীন সব নারীর শরীর
বাড়তি যত্নের দাবি রাখে। আমাদের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীদের এখনও
স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সামর্থ্য নেই, অনেকে তো বিলাসিতা ভাবেন বা এর
ব্যবহারই জানেন না। তারা ঋতুকালীন সুরক্ষার জন্য দেশীয় পদ্ধতিতে পুরোনো
কাপড় বারবার ধুয়ে-শুকিয়ে ব্যবহার করেন। দুর্যোগ ব্যতিরেকে রৌদ্রোজ্জ্বল
দিনে শিশুর কাঁথা-কাপড়, নারীর রজঃ সুরক্ষার কাপড় বা পরিধেয় বস্ত্র হয়তো
সহজেই শুকিয়ে যায় কিন্তু একটানা বৃষ্টি-বন্যা-দুর্যোগের ঘনঘটায়? আপন
গৃহকোণে তবুও নিজের মতো করে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই বলে আড়ালহীন
আশ্রয়কেন্দ্র, খোলা বাঁধ বা সড়কের ওপর পলিথিনের বাড়িতে একান্ত ব্যক্তিগত
জায়গার প্রত্যাশা হাস্যকরই বটে। চিকিৎসকেরা বলেন, নারীর মেয়েলি রোগ অনেকটাই
রজঃকালীন অপরিচ্ছন্নতা ও অসাবধানতার কারণে হয়ে থাকে। দুর্যোগকবলিত
নারীদের নিয়ে তাই আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্তত দুর্যোগের কাল না কেটে যাওয়া
পর্যন্ত চাল, চিড়া, মুড়ি, গুড়, স্যালাইন, শাড়ি, লুঙ্গির সঙ্গে যদি ত্রাণ
হিসেবে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করা যেত, তাহলে নারীদের ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য
সুরক্ষায় হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলত। তবে এ প্রত্যাশা কারও একার নয় যে
দুর্গত এলাকায় আমাদের নারীরা তাদের ব্যক্তিগত শারীরিক অসুবিধার দিনগুলোকে
খানিকটা মসৃণ ও আরামদায়ক হিসেবে পাবে। অনেক সময় আশ্রয়কেন্দ্রে নারীর কাপড়
পরিবর্তন করার পরিবেশও থাকে না অনেক সময় ভেজা কাপড় বা এক কাপড় পড়ের
দীর্ঘসময় অতিক্রম করতে হয়।

আশ্রয়কেন্দ্রে আরও যেসব প্রতিকূল
পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে সেগুলো হলো, শৌচাগার ব্যবহার করতে না পারা।
একটিমাত্র শৌচাগার, আর আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল চার-পাঁচশ’ মানুষ। পুরুষদের কারণে
মেয়েরা সেই শৌচাগার ব্যবহার করতে পারে না। নারীর ভোগান্তি পরুষদের তুলনায়
অনেক বেশি। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে নারীর সংসারের কাজ বেড়ে
যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়াসহ তারা নানা রোগে আক্রান্ত
হয়। নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় অনেক সময় বিভিন্ন
জায়গা থেকে যে ত্রাণ পাঠানো হয়, তা পুরুষেরা পান, নারী অবধি সেগুলো পৌঁছায়
না। নারীদের সঙ্গে থাকে তাদের শিশুরা। দুর্যোগের সময় শিশুদের আবদ্ধ
অবস্থায় থাকতে হয়, তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে পরোক্ষভাবে
নারী ও শিশুরাই বেশি ক্ষতির শিকার হয়।

মায়ানমারের সেনাবাহিনীসৃষ্ট
দুর্যোগে রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু জীবন বাঁচাতে মায়ানমার থেকে পালিয়ে
আসা অনেকে বিশেষ করে নারীরা এখন বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
নারীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ কারণ আশ্রয়কেন্দ্রর ও নারীবান্ধব
পরিবেশের অভাব। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে।
পানিতে সাঁতার কেটে, হেঁটে আসার সময় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেকে অসুস্থ
হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুরা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে ঠিকমতো খেতে পারেনি। এই কারণে পুষ্টিহীনতা রয়েছে।
রোহিঙ্গা শিশুরা মায়েদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে না। তারা
অপুষ্টিতে ভুগছে। মা যদি যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার পায় তাহলে শিশুরাও ভালো
থাকবে। শিশুদের ভালো খাবার প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে সরকারের একার পক্ষে সব
কিছু করা সম্ভব নয়। বন্যা, সাইক্লোন কিংবা প্রাকৃতিক ও মানুষসৃষ্ট যে কোন
দুর্যোগ বা সমস্যার সময়ে আমাদের সবাইকে বিশেষ করে সামর্থ্যবানদের এগিয়ে
আসতে হবে। দাঁড়াতে হবে বিপন্ন মানুষের পাশে, নারীদের পাশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *