সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন

হীরেন পণ্ডিত: নারীদের জন্য যে নতুন উন্নয়ন মডেলের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে,
সেখানে মূলত মোটা দাগে ৪টি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। প্রথমত, ভূমি ও
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নারীর মালিকানা স্থাপন। দেখা যাচ্ছে যে, ভূমির ওপর
নারীদের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে পরিবার ও জনগোষ্ঠীর খাদ্য
সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থার
নিশ্চয়তা তৈরি হয়। অনেক দেশেই ভূমির ওপর নারীর অধিকার আইন, পারিবারিক আইন ও
বৈবাহিক সূত্র দ্বারা সীমিত করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভূমি
শুধু আয়ের উৎস নয়, এটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ২০১৫
পরবর্তী পরিকল্পনায় ভূমির ওপর নারীদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার
পাশাপাশি পানি, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদির ওপর তাদের মালিকানা
প্রতিষ্ঠা ও তা নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, লক্ষণীয় যে,
ভূমিদস্যু, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভূমি মালিকদের
দ্বারা ভূমি দখলের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, এর ফলে গ্রামে বসবাসরত
পরিবারের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক এক গবেষণায়
দেখা গেছে উন্নয়নশীল দেশে কোম্পানি ও সরকারি দখলে রয়েছে ২০৩ মিলিয়ন হেক্টর
জমি। আমাদের জানা প্রয়োজন যে কত পরিমাণ জমি নারী, ক্ষুদ্র কৃষকদের
মালিকানায় রয়েছে, সেই সঙ্গে কি পরিমাণে থাকা উচিত ছিল এ বিষয়ে পরিষ্কার
তথ্য থাকা দরকার।

এরপর আসে মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি। নতুন
উন্নয়ন মডেলের বিষয়ে ভাবতে হলে প্রথমেই আমাদের শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির
বিষয়টি আলোচনায় আনতে হবে, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের মজুরির বিষয়টি। মানসম্মত
কাজের পরিবেশ ও ন্যায্য মজুরি ব্যতীত দারিদ্র্যবিমোচন কখোনোই সম্ভব নয়।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে, আমাদের শ্রমিকের অধিকাংশই নারী শ্রমিক যারা
গার্মেন্ট, কৃষি, ঘর-গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং
তাদের অবস্থা শোচনীয়, দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। দারিদ্র্য ও ঋণের কারণে
তারা নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করছে ফলে তাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য ও
নিরাপত্তা এবং পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উপেক্ষিত হচ্ছে। আমাদের এমন
একটি উন্নয়ন মডেল দরকার যেখানে শ্রমিক, তার পরিবারের নিরাপত্তার পাশাপাশি
মানসম্মত মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে করে একজন নারী শ্রমিক
সম্মানের সঙ্গে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।

তারপর প্রয়োজন
শান্তি ও ন্যায় বিচার বা নায্যতা। একটি ন্যায্য ও টেকসই উন্নয়নের জন্য
শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নারীর
নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রশ্নে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া নারী অধিকার
নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে
সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। সহিংসতার ফলে নারী ও শিশু গৃহহীন,
স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। সব
স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
জরুরি, এটা শুরু করতে হবে ঘর থকে এবং সরকারি উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তা বলবৎ
থাকবে। প্রকৃতপক্ষে, নারীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নারী অধিকার, লিঙ্গ সমতা,
টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত।

দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত
করার পাশাপাশি একটি একীভূত সমাজ বিনির্মাণে টেকসই উন্নয়ন খুবই জরুরি। নারীর
প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এবং নির্মূলে একটি শক্তিশালী জাতীয় পরিকল্পনা
প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে শতকরা ৫০ ভাগ নারীর অংশগ্রহণ থাকতে
হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে বহু
অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা যাতে ৬০ ভাগ নারী ও কমপক্ষে ২৫
ভাগ নারী আন্দোলনের কর্মীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। নীতি-নির্ধারণে
লিঙ্গ সমতা ও এর অগ্রাধিকার থাকতে হবে তাহলেই বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে
পৌঁছুতে পারবে।

নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও নারীর
প্রতি সহিংসতা এখনও অনেক পিছিয়ে। এখনও শতকরা ৬০ শতাংশের বেশি নারী তাদের
পারিবারিক জীবনে কখনো না কখনো সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন
ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছে,
কিন্তু সার্বিক বিষয়ে অগ্রগতি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। নারী উন্নয়ন ও
ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে,
একথা সত্য, ৭ম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় বালাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি
মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করার জন্য এদেশের নারী সমাজকে অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের
আরেকটি বড় অর্জন হলো স্থানীয় সরকার আইন। এই আইনের ফলে নারীদের স্থানীয়
সরকার নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার অধিকার। নির্বাচিত
নারীদের এলাকায় সম্মান ও ক্ষমতা দু’টোই বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা
পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ফলে তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা তাদের
সমস্যাগুলো সহজেই তুলে ধরতে পারছে।

বাংলাদেশে নারী মুক্তির ইতিহাস
দীর্ঘদিনের, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে নারীর
ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও আইনি
কাঠামো, সচেতন নাগরিক সমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন শক্ত ভিত্তির
ওপর দাঁড়িয়েছে, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারী-বান্ধব পরিবেশ
সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য
দূরীকরণ (সিডও) সনদে স্বাক্ষর করেছে।

শিক্ষায় নারীর প্রতি বৈষম্য
দূর করা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষায় নারীদের
অংশগ্রহণ বৃদ্ধি নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করাই হলো অন্যতম প্রধান
লক্ষ্য। নারীর ক্ষমতায়নকে উন্নয়নের

নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও অনেক পিছিয়ে। এখনও শতকরা ৬০ শতাংশের বেশি নারী তাদের পারিবারিক জীবনে কখনো না কখনো সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছে, কিন্তু সার্বিক বিষয়ে অগ্রগতি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়

প্রধান বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কারণ
নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে
সক্ষম হয়েছে পেরেছে এবং অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে।

নারীর ক্ষমতায়নে
বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়, যেমন ইউনিয়ন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে
নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জাতীয় সংসদে নারীর
অংশগ্রহণের হার আশাব্যঞ্জক।

‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই কার্যক্রমের মূল
উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার হার বাড়ানো এবং বিশেষ করে নারী শিশুদের শিক্ষার আওতায়
নিয়ে আসা। শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা যা শিক্ষায়
সমতা তৈরির ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অর্জন এনে দিয়েছে। এই শিক্ষাবৃত্তি
কার্যক্রম বিশ্বে একটি বেস্ট প্র্যাকটিস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ কথা
অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা
বেষ্টনীর বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন- বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, দুগ্ধবতী মায়েদের
জন্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা প্রদান করেছে যা অতি দরিদ্র
নারীদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *