হাওর রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ দরকার



হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোট ১৪২টি হাওর রয়েছে। বিস্তীর্ণ মিঠাপানির উন্মুক্ত জলাশয়ের ভূমির আয়তন ২৮.৩৩ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি বছরে ৪-৬ মাস ৩-৬ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে।

হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে মাছ রয়েছে ২৬০ প্রজাতির এবং চিংড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে ২৪ প্রজাতির। বাংলাদেশের মোট আহরিত মাছের শতকরা ২৫ ভাগ মাছ হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া হাওর এলাকায় দেশের শতকরা ১৮ ভাগ চাল উৎপাদিত হয় এবং ২২ ভাগ গবাদিপশু পালিত হয়। সব মিলিয়ে ১৩ হাজার কোটি হাজার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এর দৃশ্যমান কারণ খুঁজে দেখা যেতে পারে। দুর্নীতি হোক বা না হোক, যেসব প্রকল্পে বাঁধের উচ্চতা কম ছিল সেসব প্রকল্পে বন্যার পানির বেশি উচ্চতায় বাঁধ ডুবত, ধানও ডুবত। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেখানে হাওরের ফসল ডুবেছে সেখানে অধিকাংশ বাঁধই পানি উন্নয়ন বোর্ডের এবং সেখানে বাঁধের উচ্চতা কম ছিল। হাওর অঞ্চলে উচ্চমাত্রার ঢলের বন্যা কখনো কখনো এপ্রিল মাসেই এসে যায়, যখন মেঘালয় ও ত্রিপুরার পাহাড়ে অথবা বরাক উপত্যকায় অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় এবং ঢলের বন্যায় অনেক হাওরের ফসল ডুবে যায়। কুশিয়ারা, সুরমা ও কংস উপত্যকায় বর্ষাপূর্ব যে কোনো ভারী বৃষ্টিপাতের পানি টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলকে লক্ষ্য করে এগোয়, তারপর দক্ষিণে সাগরের দিকে গড়ায়। হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ১২৬ কোটি টাকার পুরোটাই জলে গেছে অনেকে অভিযোগ করেছেন। গত ৬ বছরে হাওর অধ্যুষিত ৬ জেলার ৫২টি হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় এই টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করা হয়। হাওরে ৮ দশমিক ৮ মিটার পানি প্রবাহের বিপরীতে ৬ দশমিক ৫ মিটার বাঁধ নির্মাণ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগাম বন্যার সময়কাল বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণ কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রেও আগের মতোই বিলম্ব করা হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

প্রায় ৭শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো উপেক্ষা করে ২০১১-২০১২ অর্থবছর থেকে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাদ দেয়ায় প্রতি বছরই দেরিতে কাজ শুরু হয়েছে। ঠিকাদাররা কাজ শুরুর পরপরই আগাম বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পানিতে বাঁধের কাজ ভেসে গেছে। ফলে পরের বছর আবার নতুনভাবে শুরু করতে হয়েছে। এভাবে ছয় বছর ধরে প্রথম থেকে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে সোয়া শ’ কোটি টাকার বেশি হাওরের পানিতে ভেসে গেছে। কিন্তু এলাকার মানুষের কোনো উপকারেই আসেনি।

‘ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যদি ৮ দশমিক ৮ মিটার পানির উচ্চতা ধরা পড়ে তাহলে কেন ৬ দশমিক ৫ মিটারের হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের ডিজাইন হবে। জেনে-বুঝে এ ধরনের বাঁধের ডিজাইন করাটাই ভুল। এ ছাড়া যেখানে বলা হয়েছে, আগাম বন্যার সময় এগিয়ে এসেছে। মার্চ-এপ্রিলেই বন্যা শুরু হচ্ছে। সেখানে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার কাজের কার্যাদেশ দেরিতে দেয়া হচ্ছে। পানি প্রবাহের সময় দুই মাস এগিয়ে আসার তথ্য দিয়েছে সিইজিআইএস (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস) ও আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং)। সেখানে বাঁধ নির্মাণের সময়ও সেভাবেই নির্ধারণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে গতানুগতিক হিসেবেই বাঁধ নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। এতে বাঁধ নির্মাণে সংস্থাটির পরিকল্পনায় ত্রুটির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১৮১ কোটি ৪১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। নদীর তীরবর্তী প্রথম বাঁধ ভেঙে গেলেও যাতে হাওরের ফসল রক্ষা পায় সে জন্য দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে ৩২ কিলোমিটার কম্পার্টমেন্টাল ডাইক নির্মাণে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩৯টি ড্রেনেজ রেগুলেটর নির্মাণে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩১ কোটি ২৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। হাওরের বিভিন্ন স্থানের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ২৯টি ড্রেনেজ আউটলেট নির্মাণে ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ৩৫টি কজওয়ে (বর্ষা মৌসুমের আগে বালির বস্তা দিয়ে গভীর গর্ত ভরাট করে হাওর রক্ষায় বিশেষ বাঁধ) নির্মাণে ১০২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়। এ ছাড়া জমিতে পানি দেয়ার সুবিধার্থে ২২টি রেগুলেটর নির্মাণে ২ কোটি ২৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, ৩৩৩ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ খাল খননে ৬৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ও ২১৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় সুরমা ও বৌলাই নদীর ৪০ কিলোমিটার খননের পরিকল্পনা পাওয়া যায় প্রকল্প পরিচালকের হালনাগাদ ডিপিপিতে। অন্যান্য খাতসহ এতে ব্যয় ধরা হয় ৭৩৩ কোটি ৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা।

হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পটি শুরুর অর্থবছরে (২০১১-১২ অর্থবছর) ১৪৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা প্রস্তাবের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে এই টাকায় কাজ দেখানো হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২০৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রস্তাবের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ওই বছর কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ পার্সেন্ট। এভাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৮১ কোটি টাকা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া হয় ২৪ কোটি টাকা। কাজ দেখানো হয়, সাড়ে তিন শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৪৮ কোটি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ওই বছর কাজের অগ্রগতি দেখানো হয় ৪ দশমিক ৯ ভাগ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩১ কোটি ১১ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়া হলেও বরাদ্দ দেয়া হয় ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছর এবং চলতি বছর ঠিকাদাররা ঠিকমতো কাজ না করায় এ বরাদ্দের একটি বড় অংশ ফেরত পাঠানোর কথা জানান। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১১৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টির তথ্য পাওয়া গেছে, যা এযাবৎকালের ইতিহাসে নজিরবিহীন। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের পানি সুরমা নদী দিয়ে সুনামগঞ্জ অতিক্রম করে। এ ছাড়া শীলচর, সিলেট ও সুনামগঞ্জেও বৃষ্টির পরিমাণ ছিল কাছাকাছি। খাল ও নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ধারণক্ষমতা কমে গেছে। কাজেই ড্রেজিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হাওর আমাদের মূল্যবান সম্পদ। হাওরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। হাওরের প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনা করে উন্নয়ন-অবকাঠামোসহ সব ধরনের কাজ করতে হবে। হাওরের একমাত্র ফসলের জন্য নদ-নদী খাল বিল ও ভরাট হওয়া হাওর খনন করতে হবে। বোরো ধান কাটার এই মৌসুমে হঠাৎ এই বন্যায় লাখ লাখ কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। এরপর পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ মরা শুরু হয়; এরপর মরতে থাকে হাঁস।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, হাওরাঞ্চলের ছয় জেলায় মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার। এ জেলাগুলো হলো সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এসব জেলায় দুই হাজার ৮৬০টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৫ হাজার ৩৪৫টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ২১৩ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে তিন হাজার ৯০২টি হাঁস ও চারটি মহিষ মারা গেছে।

কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারি ব্যাংক কৃষকের ঋণের সুদ অর্ধেক মওকুফ করেছে। স্থগিত করেছে কৃষিঋণ আদায়। হাওরের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করে টিকে আছে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাওরের কৃষক। একমাত্র ফসল চলে গেলে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা। এবারের হাওরের দুর্যোগকে ছোট করে না দেখে সরকার ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আর বিরাজমান বাস্তবতার কারণেই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দায়িত্ব নিয়েছেন। সম্প্রতি দুর্গত এলাকা সফর করে এসেছেন। বাঁধ ভেঙে সর্বনাশ তো এই প্রথম হয়নি; এর আগে ১৭ বছরে আটবারই বাঁধ ভেঙে তলিয়েছে হাওরের ফসল। এবার ক্ষতি সর্বনাশা হওয়ায় বিষয়টি বেশি আলোচনায় এসেছে। হাওরকে রক্ষা করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, সরকার যত দ্রুত সমন্বিত উদোগ নেবে ততই হাওরবাসীর জন্য মঙ্গল।

হীরেন পণ্ডিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *