চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কভিড-১৯ এর কারণে মিডিয়ায় সংকট

হীরেন পন্ডিত

বিশ্বব্যাপী বার্তাকক্ষগুলো এখন পর্যন্ত গভীরভাবে টেকনোলজির ঘাটতি মোকাবেলা করছে। অর্থাৎ, মানুষের কাছে সময়মত ও সঠিক তথ্য পৌঁছানোর মিশনে যেতে সাংবাদিকদের ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি বেশ। বার্তাকক্ষের মাত্র ৫ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজি-সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি আছে। ২ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজির বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। ডিজিটাল বিপ্লব চললেও বেশির ভাগ বার্তাকক্ষ সনাতনী স্থাপনা দিয়েই চলছে। অর্থাৎ, ওইসব গণমাধ্যমের রিপোর্টার, সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখকরা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে কম সম্পৃক্ত। অধিকাংশ গণমাধ্যম মৌলিক বিশ্লেষণী ডেটা ব্যবহার করে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। এ অবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পাদক, ডিজিটাল কনটেন্ট উৎপাদক, অ্যানালাইটিক এডিটর গোত্রীয় মাত্র ১৮ শতাংশ গণমাধ্যমের নতুন ডিজিটাল সংশ্লিষ্টতা পরিলক্ষিত হয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্বের অর্ধেকেরও কম সাংবাদিক ও বার্তাকক্ষ তাদের যোগাযোগ সুরক্ষিত রাখে। সাংবাদিকদের অত্যাধুনিক ডিজিটাল দ্রব্যাদি ব্যবহার প্রবণতা, জ্ঞান ও এর সঙ্গে পরিচিতি খুবই কম। আগামী দিনের গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য যে তিনটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার একটি হলো বিশ্বাসযোগ্যতা যা অনেকদিন ধরেই আছে।

গণমাধ্যমের আয়-উৎসও আগে কম-বেশি ছিল। এসব নিয়েই গণমাধ্যম এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যে টেকনোলজিক্যাল অভিযোজনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে তা আয়ত্তের বিকল্প কোথায়? তথ্য প্রযুক্তির কারণে একনিষ্ঠ পাঠক-দর্শকের চ্যালেঞ্জও প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্বের হুমকি নিয়ে আসবে কিনা সময় বলবে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট এবং অনলাইন-এসব বিভিন্ন শাখার মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক সংকটের কথা সামনে চলে আসছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও বেসরকারি রেডিওগুলোরও অবস্থা একই দাঁড়িয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াতে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন, এটি প্রায় নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ মিডিয়া আর্থিক সংকেট ভুগছে এমনকি নিয়মিত বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু সাংবাদিকরাই নন, গণমাধ্যমে কমরত সাধারণ কর্মীদের একই অবস্থা। তারপর গত কয়েক মাস থেকে শুরু হয়েছে কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সংকট। মানুষ এখন ভয়ে বা আতঙ্কে ছাপা পত্রিকা পড়ার আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। কবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে কেউ বলতে পারছেনা।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ বেশি হলেও সেখানে সংকট কেন? গত দুই দশকে গণমাধ্যমে পরিবর্তন যা হয়েছে, তার বড় দিক হচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিও’র সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে। আরও ১৫টি স¤প্রচারে আসার অপেক্ষায় আছে। ২৬টি বেসরকারি রেডিও চালু রয়েছে। ১৮টি কমিউনিটি রেডিও তো চালু আছেই।

মানুষ এখন অনলাইনে সব পত্রিকা দেখছে, পড়ছে! ইউটিউবসহ সোশ্যাল মিডিয়া এখন জনপ্রিয় হয়ে পড়ছে। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারাও বিদেশী চ্যানেল বা সোশ্যাল মিডিয়াতে যাচ্ছে। আর এ কারণে বাংলাদেশের মিডিয়া অর্থ সংকটে পড়ছে। অভিযোগ আছে অনেক মিডিয়া রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। তবে বিজ্ঞাপনের ছোট বাজারের কারণে মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও এখনকার সংকটকে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। তবে সরকার বলছে মিডিয়া সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজকর্ম পরিচালনা করছে কোন হস্তক্ষেপ নেই, যে যা খুশি লিখতে পারছে. বলতে পারছে।

সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ঊর্ধ্বতন এবং এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক পরিচয়ও একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে বলে অনেকে মনে করেন। মিডিয়া কর্মীদের অনেকের মতে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিড়ের মাঝেও সংবাদপত্র আস্থা নিয়ে টিকে আছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে প্রিন্ট মিডিয়া সংকটে পড়ছে। এখন কোন ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই মানুষ এখন ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা জেনে যেতে পারছে। ফলে ২৪ঘন্টা অপেক্ষা করে পরদিন গিয়ে সেই সংবাদ পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকেও প্রিন্ট মিডিয়ার বা সংবাদমাধ্যমের সংকটের একটা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। সংবাদপত্রের কর্মী ছাঁটাই একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে যাচ্ছে। একটা চরম সংকট দৃশ্যমানও হচ্ছে।

বাংলাদেশে কত অনলাইন পত্রিকা রয়েছে তার সঠিক কোন সংখ্যা নেই। প্রথমবারের মতো এগুলোর নিবন্ধনের জন্য সরকার আবেদনপত্র নিয়েছে। তাতে আড়াই হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। এই মাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে বলেছেন, হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল মানুষের আস্থা পেয়েছে। ফলে তারা ভাল বিজ্ঞাপন পেয়ে লাভবানও হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ অনলাইনই এখনও সেভাবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি এবং সেটাই এই মাধ্যমের সংকটের একটা বড় কারণ।

অনলাইন পত্রিকাগুলো আস্থার সংকটে পড়ছে এবং সেজন্য বিজ্ঞাপন যাচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইনের কাছে। ফলে বেশিরভাগ অনলাইন পোর্টাল অর্থ সংকটে রয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা এবং অনলাইন-পুরো মিডিয়ার আয়ের মুল উৎস বিজ্ঞাপন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। তাদের ছোট এই বাজারে এখন অনেক মিডিয়া ভাগ বসাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বাজার। এর মাঝে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থে বিজ্ঞাপন বিদেশী চ্যানেল এবং ইউটিউব, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সারাবিশ্বেই প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমে একটা অস্থিরতা চলছে। এটা হয়তো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কভিড-১৯ এর প্রভাব। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *