বৈষম্য কমানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

হীরেন পণ্ডিত

করোনা মহামারির কারণে ধনী আরো ধনী হয়েছে এবং দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়েছে। ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রের ব্যবধান কেবল বেড়েই চলছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপশি এ বিষয়টি নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। দারিদ্র্য এবং অসমতা বৃদ্ধির ফলে দেশে ও সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, তা কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। আর পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য বৃদ্ধি হ্রাসে দৃষ্টি দিতে হবে।

এ সমস্যা এখন প্রতিটি দেশের এবং সারা বিশ্বের। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য পুরো বিশ্বকে আরো বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জুকারবার্গ এবং বিল গেটসের মতো বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা আরো ধনী হচ্ছেন। পৃথিবীর ১০ ধনী ব্যক্তির মিলিত সম্পদ এ সময় ৭০০ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে। দৈনিক আয় বেড়েছে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার। অথচ, মুদ্রার অন্য পিঠ দেখলে পৃথিবীর প্রায় ২০ কোটি মানুষ পড়ে গেছেন নতুন গরিবের তালিকায়।

এরই মধ্যে আমাদের দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় আবার বেড়েছে। আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার বা ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা। গত অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার বা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আয় বেড়েছে ২৩৩ ডলার। সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও এর সুফল সাধারণ মানুষ কতটা পাচ্ছে সে প্রশ্ন সামনে আসছে। করোনার কারণে দুই বছরে অধিকাংশ মানুষের আয় কমে গেছে বলে জানা যায় বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষকে ভোগব্যয় কমাতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। এদিকে সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকলেও দেশে ধনীর অনুপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা লাখ পেরিয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে- এগুলো আশাজাগানিয়া ও ইতিবাচক বিষয়। সেই সঙ্গে ধনী-গরিবের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে সে বিষয়েও কাজ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ, দপ্তর, মন্ত্রণালয়গুলো সময়ে সময়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে, যার ফলে সম্ভাবনার নতুন নতুন খাতের বিকাশ ঘটে। সম্ভানাময় নতুন নতুন খাতগুলো বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনে ও অগ্রযাত্রায় বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই অক্ষম, দুর্বল, মেধাহীন নয়। তারা অনেক পরিশ্রম করতে পারে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ যারা এর আগে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আর অসহায়ত্বের বেড়াজালে নিজেদের বন্দি করে রেখেছিল, তারা এখন নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি, সাহস, পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজেই নিজের ভাগ্য নতুনভাবে গড়ে তুলছেন অনেকে। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা, জনপদের চিত্র।

দারিদ্র্যবিমোচনের বিভিন্ন প্রয়াস বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই প্রশংসনীয় সাফল্য সত্ত্বেও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের যে আরো অনেক দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে সেটি পরিষ্কার হয়েছে সরকারি সংস্থা পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়, দারিদ্র্য নিরূপণের নতুন এক সূচকে দেশের সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দরিদ্র। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচকে (এমপিআই) দেশে এ পরিমাণ দরিদ্র রয়েছে বলে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মসংস্থান হ্রাস ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অনিয়মের কারণে গরিব মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে ধনীদের সম্পদ। তবে সরকারের পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, কোনো দেশ যখন দ্রুত উন্নয়ন করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্য বাড়ে। সরকার বৈষম্য কমাতে দরিদ্রদের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাই বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশজুড়ে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং আয়বৈষম্য কমাতে সরকারের নানা প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের সুফল দৃশ্যমান নয়। বরং দেশের গরিব মানুষ দিন দিন আরো গরিব হচ্ছে, দ্রুত সম্পদ বাড়ছে ধনীদের।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই তালিকায় বাংলাদেশের সামনে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত রয়েছে। বাকি তিনটি দেশ হলো আফ্রিকার নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। আবার অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়েও বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির চেয়ে বেশি। শতকরা হিসাবে এক বছরে কোটিপতি বেড়েছে ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সপ্তাহে মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৫ ডলার ধরা হয়েছে। আগের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। করোনার মধ্যে যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির ছিল, সেখানে আয় কীভাবে বাড়ল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বৈষম্যের কারণে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ায় মাথাপিছু আয় বাড়লেও দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কতটা বেড়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। মাথাপিছু আয়ের ৪টি খাত। কৃষি, শিল্প, সেবা এবং প্রবাসীদের আয় (রেমিট্যান্স)। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে রেমিট্যান্স যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়। আর জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুসারে দেশের প্রতি মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৫ ডলার। প্রতি ডলার ৯০ টাকা হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায়, যা ২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে একজন নাগরিক প্রতি মাসে ২১ হাজার ১০০ টাকার ওপরে আয় করেন। আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে তারও এই পরিমাণ আয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের যে তথ্যের কথা বলা হচ্ছে, দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। কারণ কর্মসংস্থান হয়েছে কম। বিনিয়োগ প্রত্যাশিত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার খুব কম। কৃষিতেও আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। এসব কারণেই অর্জনের এই তথ্য মাত্রাতিরিক্ত মনে হচ্ছে।

কোনো দেশের সম্পদ ও আয়ের অসমতা বোঝাতে গিনি গিনি কো-ইফিশিয়েন্ট সূচক ব্যবহার করা হয়। এই সূচক যত বাড়বে, ওই দেশে বৈষম্য তত বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের গিনি কো-ইফিশিয়েন্ট ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮।

ওই তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে দেশের ধনী শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের আয় ছিল মোট আয়ের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর ২০১০ সালে যা ছিল ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের দশমিক ২৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ সালে ৫ শতাংশ গরিবের আয় ছিল ৭৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ধনীদের আয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। বিপরীতে কমছে গরিবের আয়। সম্পদ বৈষম্য আরো বেড়েছে।

বিবিএসের হিসাব আরো বলছে, বর্তমানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র ৭ শতাংশ। এদিকে আয় বাড়লেও কর আদায় বাড়েনি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে টিআইএন রয়েছে ৭৩ লাখ। মাত্র ২৩ লাখ মানুষ আয়কর দেন। বর্তমানে কর আদায় জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় যা সবচেয়ে কম। ২০১০ সালে জিডিপিতে বড় ও মাঝারিশিল্পের অংশগ্রহণ ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ২০১০ সালে জিডিপিতে ক্ষুদ্রশিল্পের অংশগ্রহণ ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে তা মাত্র ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। এর অর্থ হলো, শিল্প খাত বড় ব্যবসায়ীদের দখলে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে কোনো দেশের তিন বছর গড় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার ছাড়ালেই তা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পড়ে। এ হিসাবে বাংলাদেশ এই সীমা অনেক আগেই পার করেছে।

সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশ। এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চণ্ডমধ্যম আয়ের দেশ। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ। আর সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশ উচ্চণ্ডমধ্যম আয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *