হীরেন পণ্ডিত :: একজন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও জনপ্রিয় কলাম লেখক-সোহরাব হাসান। ১৯৫৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত।
বর্তমানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক। জনকণ্ঠ, দৈনিক দেশ, বাংলার বাণী, জনপদ, ভোরের কাগজ, সংবাদ এবং যুগান্তর-এ কাজ করেছেন। সামাজিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে তীক্ষ্ন ও যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সোহরাব হাসানকে জনপ্রিয় কলাম লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর লেখার বিষয় সমসাময়িক হলেও স্থায়ী আবেদন রাখতে সক্ষম হয়েছে। কবিতা তাঁর অভিনিবেশের মূল কেন্দ্র হলেও রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস ইত্যাদিও তাঁর চর্চার অন্যতম বিষয়।
সেই চর্চার অংশ হিসেবে তিনি লিখেছেন রাষ্ট্র ও সংখ্যালঘু, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধ, মুজিব ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তাননামা, রাজনীতি কার নীতি, নেই গণতন্ত্রের দেশে, ১৯৭১: বাংলাদেশের শত্রæমিত্র ইত্যাদি।
যাঁরা লেখেন, তাঁরা এক ধরনের বিষয় অনুধাবন করেন, যা সাধারণ মানুষের চাইতে একটু আলাদা একটু অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গী। সবসময় নিজের অভিজ্ঞতার কথাই যে তিনি লেখেন তা নয়, তিনি সময়কে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। সোহরাব হাসানের লেখায় আমরা জীবন দর্শন দেখি, একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি লিখেন, সমকালীন বিষয় নিয়ে মানুষের কল্যাণের জন্যই লিখেন। সমস্যার ভেতরে গিয়ে দেশ মাতৃকার কল্যাণের জন্য লেখেন।
আবার নিজের অনুভ‚তি মিশিয়ে তিনি লিখেন। তিনি লিখেন তার নিজস্ব জীবনদর্শন নিয়ে, সমাজের কথা নিয়ে। তাঁর লেখায় মানুষের জীবনের সমস্যার কথা আছে. জীবনের কথা আছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা আছে। দেশের আপামর জনগণ তাঁর চিন্তায় থাকে, এদেশের মানুষ ও মানুষের কল্যাণ নিয়েই তারঁ পথচলা। সব নিয়েই তিনি ভাবেন সমানভাবে, মানুষের দুঃখ কষ্টে ব্যথিত হন।
তাঁর লেখায় বা কলামে বর্তমান সময়কে নিয়ে লিখেন, বর্তমানের চোখে ভবিষ্যতকে দেখেন, আবার সময়কে নিয়ে এগিয়ে যান, সবকিছুকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। তাঁর রাজনীতি এখন আর কোনো দলীয় রাজনীতির মধ্যে নেই। সামগ্রিক মানবমুক্তির লক্ষ্যে কাজ করাটাকেই তিনি রাজনীতির কথা হিসেবে ভাবেন। তিনি মনে করেন মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত মানবতা। পাশবিকতা কিংবা দানবিকতা নয়। মানুষকে ভালোবাসা মানবতার প্রাথমিক কাজ। তিনি মানবিকতার ধর্মে বিশ্বাস করেন। প্রচলিত যেসব আচারনিষ্ঠ ধর্ম, সেগুলো যারা পালন করে তাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।
কবি, সাংবাদিক ও কলম যোদ্ধাকে কখনো সময় দিয়ে আবদ্ধ করা যায়না, তাঁরা সব সময়ের জন্য। আমৃত্যু তিনি লিখে যান এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সে কি এক অনুভূতি পাই আমরা তাঁর লেখায় আলোচনায়, দর্শনে, জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, আপন প্রত্যয়ে। তিনি লিখেন বা লেখার ভাবনা যেন থাকে তার ভেতর সে প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন সাবলীলভাবে উঠে আসে, এই কলম সৈনিকের লেখায়।
সোহরাব হাসান একজন আদর্শবান মানুষ। নিজ আস্থার সাথে এগিয়ে যাওয়াকে আমরা দেখি খুব কাছে থেকে। মা, মাটি, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা দেখেছি তাঁর কাছে। সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের প্রতি এবং এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার সে প্রচেষ্টায় সব সময় অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করছেন। কোনোদিন অসত্য আর আদর্শহীনতার সাথে আপোস করতে দেখিনি।
দৈনিক প্রথম আলো’র সম্পাদকীয় পাতায় কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান-এর লেখা কলামগুলো সাহস যোগায় এদেশের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে। এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর কলম চলে নিরন্তর। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে লেখা কলামগুলো পড়ে কিছুটা হলেও মনে প্রশান্তির ছোঁয়া পায় এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব মানুষ। প্রত্যাশা বেড়ে যায় মুক্তিকামী মানুষের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, পাবনা, ভোলা, রামুসহ সারাদেশে যেকোন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটলেই তাঁর কলম জেগে উঠে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁর সবসময়ই কলম জেগে উঠে। দাঁড়ান নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে। এই কলম সৈনিক মানুষ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শুভবোধের পক্ষে দাঁড়িয়ে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে উচ্চকিত করেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেতনায়। তখন সত্যিই মনে হয় এটিই আমাদের সত্যিকারের বাংলাদেশের চিত্র ও প্রতিচ্ছবি!
সোহরাব হাসানের লেখার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরাও বলতে চাই ‘বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ’। আমাদের প্রশাসন খুবই দায়িত্বশীল। রাজনীতিকেরা পরমতসহিষ্ণুতার জ্বলন্ত প্রতীক। আমাদের নাগরিক সমাজ মানবাধিকারের বলিষ্ঠ রক্ষক।
সোহরাব হাসানকে এই আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠার কারণে তাঁকে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে, এমনকি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন। কারো কারো চোখ রাঙানো সহ্য করতে হয়েছে। নানা হুমকি মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে কোন কিছুই তাঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কলম হাতে তুলে নিয়েছেন তার জন্য কখনোই আপোস করেননি।
আজকাল তাঁর মতো সৎ ও আদর্শবান মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আজকাল আদর্শ বলি দিয়ে নিজের আখের গোছানোর যে প্রবণতা আমাদের সমাজে চলছে তিনি তার ব্যতিক্রম। আমাদের সমাজে সৎ, আদর্শবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূজারীদের সব ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকা উচিত। জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা। এই অস্থির সময়ে আপনার মতো একজন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন এদেশের মানুষের খুব প্রয়োজন।