কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা জরুরি


হীরেন পণ্ডিত

আমাদের বাজেটকে গণমুখী করা খুব জরুরি। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। আমাদের জোর দিতে হবে কর্মসংস্থানের ওপর। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি মা-বাবার দায়িত্ব রয়েছে, নাগরিক সমাজের ভূমিকা রয়েছে, প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সরকারি দল, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজসহ সমাজের সবার দায়িত্ব রয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ; দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত রেখে এবং দুর্নীতিমুক্ত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। পাস করে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। বড় ডিগ্রি নিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উচ্চশিক্ষায় যায় সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী। অথচ আমাদের এখানে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যবস্থা। কোনো রকম একটি চাকরি জোটাতে চাইলেও উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি থাকাটা জরুরি। সেটি যে পদেই হোক না কেন!

আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। নতুন কর্মসংস্থান না হলে এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে বেকার হয়ে থাকতে হবে। পাস করে চাকরির বাজারে টিকতে পারছে না অনেকে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছে অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রায় ১০ শতাংশ বেকার। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই হারে বেকার আছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক যুবসমাজের বেকারত্ব নিয়ে যে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের এ চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার দুই শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার আটে উন্নীত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে চার শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব শ্রমশক্তি ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। আর বাকি সব কোনো না কোনোভাবে বেকার থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুব বেকারত্বের হার অনেক বেশিই। কেননা বাকি যারা কাজ করে, তাদের অনেকেই ছদ্মবেকার। অনেকেই টিউশনি করে, পার্টটাইম কাজ করে, তাদের বেকার হিসেবে ধরা হয় না। এতে যুবশক্তির উৎপাদনশীলতার পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না বা করার ব্যবস্থা করতে পারছি না। শ্রমবাজারে যে ধরনের দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন, সে অনুযায়ী কর্মীর চাহিদা পূরণ করতে পারছে না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কাজের বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বিশেষায়িত দক্ষতার ঘাটতির কারণে উচ্চশিক্ষার পরও ভালো কাজ পাচ্ছে না স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করা তরুণ বয়সীরা। স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কাজের বাজারের চাহিদার মধ্যে বিশাল ফারাক থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। জোগান ও চাহিদার গরমিল থেকে যাচ্ছে। শিল্প যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী খুঁজছে, তা মিলছে না। ফলে বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ করাতে হচ্ছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে, বেকারত্ব তত বাড়ছে। তাই শিক্ষাপদ্ধতি হতে হবে কর্মমুখী। এটি ভাবার মনে হয় সময় এসেছে।

আমরা মনে করি এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি ও অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর প্রকাশিত জানুয়ারি-২০১৬ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শ্রমবাজার ও চাকরির বাজার সংকুচিত হবে বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বে। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কমবে চার শতাংশ হারে। ফলে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার থাকবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এই বেকার জনশক্তি। এর জন্য বেকার যুবক-যুবতীদের মধ্যে হতাশাও দেখা দিচ্ছে। তাই আমরা মনে করি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুসারে এখানকার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ এবং তৈরি পোশাক খাত, পর্যটন ও পর্যটনসেবা, হালকা কারিগরি নির্মাণ খাত। কিন্তু এসব খাতের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত যথাযথ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন (বিশেষায়িত ও সাধারণ) কর্মীর অভাব রয়েছে। এর জন্য কী ধরনের দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাক্রম তৈরি করা জরুরি। বাংলাদেশের পোশাক খাত এত বড়, কিন্তু উচ্চশিক্ষায় এই খাতের কোনো গুরুত্ব নেই। একই কথা চামড়া খাত নিয়েও। ফলে এই খাতগুলো বিদেশি কর্মিনির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে বিশেষায়িত কাজের জন্য দেশে ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী না পেয়ে উদ্যোক্তারা বিদেশি কর্মী নিয়োগে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষা পরিকল্পনায় গলদের কারণে বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিজের আগ্রহ ও পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে বিষয়ে সুযোগ পায়, সেটা পড়তে বাধ্য হয়। আর চাকরির ক্ষেত্রে যেখানে সুযোগ আসে সেখানেই যোগ দিতে হয়।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষায় কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এ জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন কাঠামো, তদারকি, মাননিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো করতে হবে। উচ্চশিক্ষা পাঠ্যক্রম তৈরিতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সময়োপযোগী করতে হবে। আইন প্রণেতা, নিয়োগকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয় দরকার। সরকারকে কিছু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করলে যে চলবে তা নয়, বরং তার যথাযথ বাস্তবায়নও জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে কর্মমুখী হিসেবে দেখতে চাই, বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত দেখতে চাই না, তরুণসমাজকে হতাশ দেখতে চাই না, উদ্যমী দেখতে চাই। যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *