চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা জরুরি

হীরেন পণ্ডিত: আগের বিপ্লবগুলোর তুলনায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কিছু গুণগত পার্থক্য আছে। এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। আগের বিপ্লবগুলোতে যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে মানুষ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যন্ত্র নিজেই নিজেকে চালানোর সক্ষমতা অর্জন করছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে যন্ত্রের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা অনেক দ্রুত। যন্ত্র অনেক নিখুঁত ও দক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইন্টারনেটের কারণে তার কার্যক্রমের আওতা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। এক দেশে বসে একটি বুদ্ধিমান কম্পিউটার অন্য দেশের একটি যন্ত্রকে আদেশ দিতে পারে, একটি যন্ত্র পারে দেশের একটি ঘরের তাপমাত্রা মেপে তা বাড়ানো বা কমানোর আদেশ দিতে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। মানুষ বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত; কিন্তু নতুন প্রযুক্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ বিপ্লবের প্রভাব মানবসভ্যতার ওপর অনেক গভীর ও ব্যাপক। এটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে, আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। যেসব দেশের কাছে প্রচুর অর্থ আছে, তারা গবেষণায় ব্যয় করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারবে। ধনী ও গরিব দেশের পার্থক্য বেড়ে যাবে। কাজগুলো ভাগ হয়ে যাবে অদক্ষ-স্বল্প বেতন ও অতি দক্ষ-অধিক বেতন—এসব শ্রেণিবিভাগে দক্ষ ব্যক্তিরা কাজ পাবে, অদক্ষ ব্যক্তিরা বেকার হয়ে যাবে। মানুষের শরীরে চিপস অনুপ্রবেশ করিয়ে রেখে দেওয়ার প্রযুক্তি বের হয়েছে। ভবিষ্যতে শরীরে স্থাপিত চিপস স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে পারবে। তবে চিপসের কারণে মানুষের ব্যক্তিজীবন বা গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে।

এসব স্মার্ট যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে পোশাকশিল্প। প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক কাজ করে এ খাতে। রোবট ও স্মার্ট যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যেতে পারে। শুধু পোশাকশিল্প নয়, আরো অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমে আসবে, রোবট ও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। চালকবিহীন গাড়ি চালু হলে চালকের চাকরিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াবে। উন্নত বিশ্বে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চালকবিহীন গাড়ি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও দক্ষ হবে। এ ছাড়া এরা ট্রাফিক জ্যাম ও দূষণ কমাবে। আমাদের দেশের অনেক চালক চাকরি হারাবেন। বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য হবে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যেসব সেবায় মানবিক ছোঁয়া আছে, সেসব সেবা দিতে মানুষের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়বে যেমন প্রগ্রামার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদিতে দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়বে। আমাদের দেশে দক্ষ প্রগ্রামারের অনেক অভাব আছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসবে। আমাদের দক্ষ প্রগ্রামার তৈরি করতে হবে।

ডিজিটাইজেশনের কারণে এখন প্রচুর ডাটা তৈরি হচ্ছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কোথায় কতক্ষণ সময় ব্যয় করছি, তার উপাত্ত আমাদের স্মার্ট গাড়ি পাচ্ছে। ব্যাংক হিসাব, মোবাইল ওয়ালেট, ক্রেডিট কার্ড মিলে আমাদের খরচের হিসাব দিতে পারে। আমরা কী দেখছি তা স্মার্টফোন ও স্মার্ট টিভির কাছে উপাত্ত আছে। এসব উপাত্ত আগে সংরক্ষণ করা যেত না। এখন ক্লাউডে সংরক্ষণ করা সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের। দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার কারণে কম্পিউটার এসব ডাটা সহজে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

কম্পিউটারকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ববর্তী পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ডাটা বিশ্লেষণ করে এআই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কম্পিউটারকে প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কম্পিউটার একটা প্যাটার্ন আন্দাজ করতে পারে। ফলে পরবর্তী সময়ে রং, সাইজ, ভঙ্গিভেদে কম্পিউটার বিষয়টি চিনতে পারে। বর্তমানে কোনো লেনদেন হলে তা লেজার বা খতিয়ানে লিপিবদ্ধ থাকে। এ লেজার কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। ব্লক চেইনে লেজারটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সব অংশগ্রহণকারীর মধ্যে। ফলে কেউ জালিয়াতি করতে পারবে না, কারণ সবার কাছে লেজার আছে। একেকটা লেনদেন একটা ব্লক তৈরি করে। সেটা আগের ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটা চেইন তৈরি করে। ব্লক চেইনে শুধু আর্থিক লেনদেন নয়; চুক্তি, জমির দলিলসহ বিনিময়ের রেকর্ড থাকতে পারবে। ব্লক চেইন প্রবর্তিত হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনেক কাজ কমে যাবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে।

ডিজাইনের ওপর পরতের পর পরত বসিয়ে কোনো জিনিস প্রস্তুত প্রণালি হলো থ্রিডি প্রিন্টিং। এর মাধ্যমে কোনো জটিল যন্ত্রপাতি ছাড়াই জটিল বস্তু (যেমন—প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক, স্টিল ইত্যাদি) তৈরি করা যায়। আগে যে জিনিস তৈরি করতে একটা কারখানার প্রয়োজন হতো, তা এখন একটা প্রিন্টিং মেশিনে তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে জিনিসপত্র তৈরি ত্বরান্বিত হবে। ‘নকশা থেকে প্রস্তুত’-এর চক্র ছোট হবে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প থ্রিডি প্রিন্টারে অনেক জিনিস নিজেরা তৈরি করতে পারবে। পরিবহন ব্যয় কমে যাবে, যা পরিবেশদূষণ কমাবে।

যন্ত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পাঠাতে পারছে। এটা ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি। উন্নত বিশ্বে আইওটি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। গাড়িতে করে বাসায় যাওয়ার জন্য আপনি যখন তৈরি হয়েছেন, আপনার গাড়ি বাসার এসির কাছে মেসেজ পাঠাবে। এসি নির্দিষ্ট সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে, যাতে আপনি যখন ঘরে প্রবেশ করবেন, আপনার পছন্দসই তাপমাত্রা পাবেন। আপনার গৃহকর্মী রোবট ফ্রিজ থেকে নাশতা নিয়ে মাইক্রোওভেনে গরম করে রাখবে। ফ্রিজ তার ভেতরে সংরক্ষিত খাদ্যসামগ্রী স্ক্যান করে, আপনার খাদ্যাভ্যাস বিবেচনা করে, অনলাইনে ই-কমার্সে অর্ডার প্রদান করে দেবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে। উন্নত বিশ্বে ব্লক চেইন, এআই, রোবটিকস, চালকবিহীন গাড়ি, থ্রিডি প্রিন্টিং নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এসবের প্রভাব আমাদের দেশে পড়বে। এখন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে আমাদের একমাত্র প্রাপ্য বিষয় হচ্ছে সস্তা শ্রম। রোবটিকস, এআইয়ের কারণে আমাদের এ সুবিধা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রগ্রামার, ডাটা অ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়বে।

তবে আশার কথা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে বলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগকে এক হাজার ৯৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং প্রযুক্তিভিত্তিক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সফল করতে ও অংশীদার হতে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার এবং ব্লক চেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার কথা তুলে ধরা হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *