হীরেন পণ্ডিত
হীরেন পণ্ডিত :: মানবসভ্যতার ইতিহাসে তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান সময়ে শুরু হওয়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। বিশেষজ্ঞরা যেভাবে বলছেন, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনও হয়নি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা সবকিছু। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে।
এখন পৃথিবীতে নতুন নতুন যেসব কৃষিযন্ত্র আসছে তাতে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস। পৃথিবীর সর্বাধুনিক কৃষিযন্ত্রগুলো আমরা লক্ষ্য করছি। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ কৃষিযন্ত্রে এখন রোবটিকস প্রযুক্তিরও সন্নিবেশ ঘটানো হচ্ছে। চিন্তা করা হচ্ছে, উৎপাদন খাতে মানুষের শ্রমকে কতটা কমিয়ে আনা যায়। একইসঙ্গে উৎপাদন দক্ষতা, পরিবর্তন দক্ষতা ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে জমি চাষে।
জমি চাষে ৯৫ শতাংশ কলের লাঙ্গল ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে ধান মাড়াইয়ে ৯৫ শতাংশ মাড়াই যন্ত্র বা থ্রেসার ও সেচ ব্যবস্থায় ৯৫ শতাংশ পাওয়ার পাম্প ব্যবহার হচ্ছে। কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে ধীরগতিতে। ফসল তোলা বা হার্ভেস্ট-এ ১.৫ শতাংশ, রোপণে দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের হার দিনে দিনে বাড়ছে। এতে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। একইভাবে আমাদের দেশের কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদিত যন্ত্রের সঙ্গে আইওটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আমদানির বাইরেও ২০ শতাংশ কৃষিযন্ত্রের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশে রয়েছে ৭০টি ফাউলি, ২ হাজার কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক কারখানা ও ২০ হাজারের মতো যন্ত্রপাতি মেরামত কারখানা। কৃষিযন্ত্রের যে কোনো পার্টসের ৬০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমান সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে বেশ জোর দিয়েছে। সব কৃষকের কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি চালু রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিভিন্ন সংস্থা কৃষি উৎপাদনে শুদ্ধতা অনুসরণের নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিষমুক্ত সবজি ফসল উৎপাদন ও মধ্যস্বত্বভোগীমুক্ত বাজার কাঠামো গড়ে তুলেছে। দক্ষিণাঞ্চলে বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন বাজার ভিলেজ সুপার মার্কেট গড়ে উঠেছে। কৃষক নিজ গ্রামেই নির্দিষ্ট একটি বিক্রয় কেন্দ্রে তার উৎপাদিত সবজি বিক্রি করছে। সেখান থেকে উন্নত ব্যবস্থাপনায় সেগুলো ভিলেজ সুপার মার্কেটে চলে আসছে। সেখানে কৃষিপণ্যের পরিষ্কার করা, বাছাই ও উন্নত প্যাকেজিং করে রাজধানীর বাজারে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়ায় সবজি বাজারজাতও করা হয়েছে। এ উদ্যোগগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও পণ্যের সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করা। এ একই প্রক্রিয়ায় মাছ, মাংস ও দুধ উৎপাদনে শুদ্ধতা অবলম্বন এবং সুনিশ্চিত বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কৃষক নিরাপদ ফসল উৎপাদনের অনুশীলনের আওতায় আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে খামারিদের মধ্যে নতুন আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলো কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তির সংযোজন করছে। বাংলাদেশেও এ স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশে দুগ্ধ খামার ও প্রাণিসম্পদের খামারে এখন আইওটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ডিজিটাল ও স্মার্টপ্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক বেশি উৎসাহিত ও আশাবাদী উদ্যোক্তারা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ডাচ্ ডেইরি লিমিটেড সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত একটি স্মার্ট দুগ্ধ খামার। যেখানে ডিজিটাল ও স্মার্ট প্রযুক্তিগুলো সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারণা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের দেশ দুগ্ধ ও মাংসের খাত প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার শুরু হবে। এতে দুধ কিংবা মাংসের পুরোপুরি শুদ্ধতা যেমন নিশ্চিত করা যাবে, পাশাপাশি উৎপাদনও বাড়বে।
আমাদের মৎস্য খাতের জন্য আশাব্যঞ্জক এক উদ্ভাবনী সাফল্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে মাছ চাষের পুকুরে অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মাছের পরিমিত খাদ্য দেয়ার প্রযুক্তি। বাংলাদেশের দুজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী তাদের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফলাফল হিসেবে উদ্ভাবন করেছেন ‘স্মার্ট অ্যারেটর ও ফিডিং ডিভাইস’। এ যন্ত্রটি আমাদের দেশের মৎস্য খাতে যখন পুরোপুরি যুক্ত হবে, তখন রাসায়নিক ও ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত মাছ উৎপাদনে এক বিস্ময়কর সাফল্যের সূচনা ঘটবে।
আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও খামারিদের কল্যাণেই আমাদের মৎস্য খাতে বিস্ময়কর সাফল্য সূচিত হয়েছে। ফসল আবাদে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ বা মাটিবিহীন ঘরোয়া আবাদ পদ্ধতির মতোই মাছ চাষেও যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ‘রিসার্কুলেটেড অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম রাস’ ও ‘বায়োফ্লক’। এ দুটি পদ্ধতি ছাড়াও পানিতে অ্যামোনিয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং চাষের ব্যয় কমিয়ে স্বল্প পরিসরে অনেক বেশি পরিমাণে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জেগেছে। বাংলাদেশের বহুসংখ্যক শিক্ষিত সচেতন উদ্যোক্তা আধুনিক এ চাষ কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে মাছ চাষে বিশ্বব্যাপী আমাদের অবস্থানকে দ্রুতই আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়াসী হয়েছেন।
আমাদের সর্বস্তরে কৃষির সেরা অনুশীলনগুলোতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত করে তোলা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির আধুনিকতর উদ্ভাবন আইওটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও জরুরি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষির বাণিজ্যিকায়নে বহুমুখী সাফল্য থাকলেও কৃষিক্ষেত্রে বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটি হচ্ছে উৎপাদক শ্রেণির অনুকূল বাজার কাঠামো। চলমান স্মার্ট প্রযুক্তির যুগে কৃষকের জন্য অনুকূল বাজার কাঠামোর কার্যকর সমাধান দেয়ার মতো কোনো প্লাটফরম আজও পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ বছর দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে কৃষক নির্বাচন করে আমন মৌসুমের ধান সংগ্রহের অভিযানের কথা জানা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ উদ্যোগও সফলতা লাভ করেনি। কৃষকের বিবেচনায় এ কার্যক্রমেও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে।
প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটছে মানুষের চিন্তা-চেতনার। ধানসহ সব খাদ্যশস্য, সবজি, ফল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে কৃষক আজকের উৎপাদন সাফল্য অর্জন করেছে। কৃষকের ব্যক্তি উদ্যোগগুলোই বাণিজ্যিক কৃষির ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাফল্য হিসেবে ধরা দিচ্ছে।
কৃষি এখন বেশি বিনিয়োগনির্ভর বাণিজ্যিক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বেশি মুনাফা ও উৎপাদনশীলতার জায়গাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষির প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। গত এক দশকের চিত্র যদি তুলে ধরা হয়, আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে যেসব কৃষি অনুশীলন তুলে এনেছি, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা কৃষক সেই অনুশীলনেই মনোযোগী হয়েছেন। বলা বাহুল্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবগুলো আমাদের দেশের কৃষিতে পুরোপুরি পড়তে শুরু করেছে।
কৃষির সর্ব পর্যায়ে যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি উদ্ভাবিত উন্নত উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। কৃষিতে আমাদের সাফল্যের পেছনে কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষিপ্রযুক্তিবিদদের বিরাট অবদান রয়েছে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তারা অন্যন্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। বিজ্ঞানীরা বহু শস্য জাতের উদ্ভাবন করেছেন। প্রযুক্তিবিদরা উদ্ভাবন করেছেন লাগসই প্রযুক্তির। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ফসলের ৫৪৫ উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ৫০৫ টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ৮৮টি ইনব্রিড ও ৬টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। আর বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ১০৮টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে।
এই প্রতিষ্ঠানটি জীবাণু সারও উদ্ভাবন করেছে। বন্যা, খরা লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যেরজাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষিপ্রযুক্তিবিদদের ধারাবাহিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের এই সাফল্য কৃষিউৎপাদন বৃদ্ধির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষিপ্রযুক্তিবিদরা শুধু বিভিন্ন ফসলের উন্নতজাত ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনই করেননি, এক সঙ্গে পশুপালন, মৎস্যচাষসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। তাদের এই সাফল্য উপযুক্ত মূল্যায়ন ও যথাযথ প্রণোদনার অপেক্ষা রাখে।
প্রয়োজনে এই ভর্তুকি আরো বাড়াতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, কৃষিশ্রমিকের অভাব দিন দিন বাড়ছে। এখন শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত। ২০৩০ সাল নাগাদ তা ২০ শতাংশে নামবে। কাজেই, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অপরিহার্যতা সহজেই অনুমেয়। কৃষিকে সহজ ও লাভজনক করতে হবে জাতীয় স্বার্থেই।