হীরেন পণ্ডিত: প্রযুক্তি জগতে এক ঘটনাবহুল বছর দেখল বিশ্ব। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ প্রযুক্তি জগতে এনেছে বড় পরিবর্তন। এর পাশাপাশি প্রযুক্তি জগতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছেন ইলন মাস্ক। এ মহামারি করোনার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির রূপান্তর সর্বজনীন ব্যবহার হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করেছিলেন মহামারির প্রকোপ হ্রাস পেলে ধীরে ধীরে হোম অফিস, ভার্চুয়াল ক্লাস ও কনফারেন্সের বদলে আবারও আগের পৃথিবীতে ফেরত যাবে মানুষ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই বছর ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর মানুষের যেই নির্ভরযোগ্যতা বেড়েছিল তা বিগত বছরগুলোতে আরও বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেটাভার্স, রোবোটিক্স, এনার্জি স্টোরেজ, ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তিসহ নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো। এ ছাড়াও জিনোম সিকোয়েন্সিং, ইনটেলিজেন্ট এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন এবং কৃষি প্রযুক্তির প্রভাব ব্যাপক।
বিগত বছরে দু’টি ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে প্রযুক্তি খাতে, যা একটি সাপ্লাই চেইন এবং অপরটি সাইবার ঝুঁকি হ্রাস। নেটওয়ার্ক এবং আইটি অবকাঠামো ক্লাউড এবং ‘৫জি’ এন্টারপ্রাইজ নেটওয়ার্ক অবকাঠামো বিনির্মাণে একত্রিত হয়ে কাজ করছে দু’টি প্রযুক্তি। সংস্থাগুলো আজ সাধারণত ৩-৬টি পাবলিক ক্লাউডে তাদের বেশিরভাগ অ্যাপ্লিকেশন হোস্ট করে, যা এই অ্যাপগুলোকে যেকোনো জায়গা থেকে সাধারণভাবে প্রবেশযোগ্য করার অনুমতি দেয়। ৫জি বিশ্বব্যাপী ডি-ফ্যাক্টো সংযোগ পরিষেবা হয়ে উঠেছে। এটি (১০০ এমবিপিএস- ২জিবিপিএস) স্কেলে ব্রব্যান্ড সংযোগে সক্ষম। ক্লাউড এবং ৫জি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কম খরচে প্রযুক্তিকে আরও কম খরচে ব্যবহার ও এর পরিষেবার পরিসীমা বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের জন্য আরও দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। মোবাইল ‘৫জি’ আরও গ্রহণযোগ্য এবং নিশ্চিত পরিষেবায় ‘৫জি-এর উদ্ভাবন, বিনিয়োগ এবং কার্যকারিতার কারণে বিশ্বজুড়ে-এর বিস্তৃতি ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের ৫জি হ্যান্ডসেট বাজারে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে ২০২১-২২ সালে ৫জি মূলধারায় পরিণত হয়:
এখন দৃষ্টি রয়েছে রেডিও অ্যাকসেস নেটওয়ার্কের (আরএএন) প্রতি। আরও বিশেষ করে বললে ওপেন-আরএএন-এ। এক্ষেত্রে অপারেটররা বর্ধিত প্রতিযোগিতার জন্য ক্লাউডের সাহায্যে খরচ কমানোর আশা করছে। ভূ-রাজনীতি এবং সরবরাহ চেইনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো ওপেন-আরএএন এবং শেয়ার্ড বা মাল্টি-টেন্যান্টেড আরএএন-এর প্রতি আগ্রহকে আরও তীব্র করেছে। এই ৫জি নেটওয়ার্কের কারণেই ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার হয়ে আসা ব্রডব্যান্ড অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে ২০২৫ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ ব্রডব্যান্ড কানেকশন ৫জি মোবাইলে শিফট হয়ে যাবে।
ক্লাউডের গুরুত্ব বেড়েছে দ্বিগুণ: বিগত বছরে আইটি যেকোনো ইন্ড্রাস্ট্রিও ক্ষেত্রে ক্লাউডের গুরুত্ব বেড়েছে দ্বিগুণ। আইটি খাতের অন্যকোনো ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। টেলিকমিউনিকেশন অপারেটরদের মূলধন ব্যয়েরও বড় একটি অংশ চলে গেছে ক্লাউডে। ধারণা করা হয়েছে আগামী ৫ বছরে এ খাতের গুরুত্ব আরও বাড়বে। ক্লাউডে কারণে আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপ্রবাহ (কর্মশক্তি ব্যয়) প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। মূলত পরস্পর মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো, গ্রহণযোগ্যভাবে তথ্য সাজিয়ে রাখা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে এই ব্যবহার বেড়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ক্লাউড এআইর থেকেও ভালো কাজ করছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এখন যেই ক্লাউডে গেম, মেটাভার্স ও ভিআর, অ্যাপস ও ওয়েবসাইট যুক্ত রয়েছে, সেখানে এআই যুক্ত হলে তা বিস্ফোরকের মতো কাজ করবে। ফলে শক্তি ও মেমোরি ব্যবহার করে তার কার্যক্ষমতা বাড়বে। এ ছাড়াও ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্যও চাহিদা বাড়ছে ক্লাউডের।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অনন্য মেট্রোরেল
মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভও দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়েছে। বিদ্যুৎচালিত এ ট্রেনের চলাচল হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কীভাবে চলছে মেট্রোরেল, প্রযুক্তিগত কী চমক আছে? বিদ্যুৎ না থাকলে কী হবে? জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে এমন নানা প্রশ্ন।
উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীকে যানজটমুক্ত রাখতে এ রেল চলবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে। মাত্র ২০ মিনিটে পাড়ি দেবে ১০ কিলোমিটার পথ। দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল শুরু হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর ২০২২।
অটোমেটিক স্টপ কন্ট্রোল
ট্রেন অটোমেটিক স্টপ কন্ট্রোলের মাধ্যমে কোথায়, কখন থামাতে হবে সেটি নির্ধারিত হবে এবং এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে চালকের বেশি কিছু করার থাকবে না। প্রোগ্রাম রুট কন্ট্রোলার সিস্টেমের মাধ্যমে ট্র্রেনের রুটগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে মেট্রোরেল পরিচালনা খুবই সহজতর হয়েছে।
ডিজিটাল টিকিট মেট্রোরেলের টিকিট পুরোপুরিই কম্পিউটারাইজড। স্টেশনের মূল প্ল্যাটফরমে ঢোকা ও বের হওয়ার মুখের দরজা খুলতে ব্যবহার করতে হচ্ছে চিপযুক্ত টিকিট। স্টেশনে যাত্রীদের তাৎক্ষণিক টিকিট কাটার ব্যবস্থার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ও মাসিক টিকিটও মিলছে বিশেষ মেশিনে। এ প্রযুক্তি তৈরি করছে সনি কোম্পানি। নির্দিষ্ট একটি কার্ড কিনে সেই কার্ডের মাধ্যমে পাঞ্চ করে টিকিট সংগ্রহ করতে হয় মেট্রোরেলে চলার জন্য। সেই কার্ড আবার পাঞ্চ করেই রেল থেকে বের হতে পারবেন যাত্রীরা।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়েও বন্ধ হবে না
এ ট্রেন চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর জন্য উত্তরার ডিপোয় সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। মতিঝিলে আরেকটি স্থাপনের কাজ চলছে। প্রতিটি সাবস্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার থাকবে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হলেও ব্যাটারির মাধ্যমে চলমান ট্রেনগুলো নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে।
সার্বক্ষণিক মনিটরিং
প্রতিটি স্টেশনে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ঘোষণার মাধ্যমে যাত্রীদের জন্য আছে দিকনির্দেশনা। স্টেশনে ও ট্রেনের ভেতরে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে চলবে সার্বক্ষণিক মনিটরিং।
স্টেশনে তাক লাগানো প্রযুক্তি
মেট্রোরেলে যাত্রী নিরাপত্তায় থাকছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। স্টেশনে ঢোকার পর থেকে প্রতিটি ধাপে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সহায়তায় সহজতর হচ্ছে যাত্রাপথ। ঢাকায় মেট্রোর প্রতিটি স্টেশনে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। এর পর প্ল্যাটফরমের নির্দিষ্ট পয়েন্টে আছে স্বয়ংক্রিয় দরজা। ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় এ দরজা। এটি নিয়ন্ত্রণের সফটওয়্যার তৈরি করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন। ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমিউনিকেশন বেজড ট্রেন কন্ট্রোল সিস্টেম (সিবিটিসি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। থাকছে অটোমেটিক ট্রেন অপারেশন (এটিও), অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন (এটিপি), অটোমেটিক ট্রেন সুপারভিশন (এটিএস) ও মুভিং বøক সিস্টেম (এমবিএস)।
এ ছাড়া আপৎকালীন পরিস্থিতিতে মেট্রোরেল স্টেশন থেকে বের হতে জরুরি বহির্গমন পথ রয়েছে। স্টেশন ও ট্রেনে রাখা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। মেট্রোরেলের পুরো লাইনজুড়ে আছে ‘নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়াল।’ এটি ট্রেন চলাচলের সময় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
সাইবার নিরাপত্তা : অপ্রত্যাশিত, অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ থেকে রক্ষা
সাম্প্রতিককালে সাইবার নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর মধ্যে এক মিল রয়েছে। সাইবার আক্রমণ আরও খারাপভাবে হচ্ছে। ডাটা নিরাপত্তা লঙ্ঘন থেকে শুরু করে র্যানসমওয়্যার (২০২১ সালে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি), ক্রিপ্টোকারেন্সি লন্ডারিং (৩০ শতাংশ পর্যন্ত)। মহামারিকালে রিমোট ওয়ার্কপ্লেসের জন্য এ ধরনের আক্রমণ ও ঘটনা আরও বেড়ে যায়। বাস্তবতা হলো, এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার সাইবার নিরাপত্তা ও এ বিষয়ক নজরদারি এবং নিয়মাবলি পালনের ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা দেখাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে সাইবার আক্রমণ তুলনামূলকভাবে আগের থেকে কঠিন হয়ে পড়েছে।
জিরো ট্রাস্ট : সাইবার বিশেষজ্ঞরা (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি, এনআইএসটি) এবং সরকার (যেমন ইউএস, ইউকে) মনে করে, একটি সুরক্ষিত নিরাপত্তাব্যবস্থা নির্মাণের ভিত্তি নীতি হলো ‘জিরো ট্রাস্ট’। অর্থাৎ ওই সিস্টেমের সঙ্গে সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ বা বাইরের কোনো ব্যক্তি, ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক পরিষেবার ওপর বিশ্বাস না রাখা।
ক্লাউড মাইগ্রেশন : ক্লাউডে হোস্ট করা কাজের চাপ ২০২০ সালে ৪৬% থেকে বেড়ে ৫৯% হয় এক বছরে। এটি গত বছর আরও বেড়েছে। নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যত দ্রæত সম্ভব তাদের সব তথ্য ও পণ্য সম্পর্কিত তথ্যগুলো ক্লাউডে স্থানান্তর করতে চায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) : সব কাজে ব্যবহার এবং উল্লেখযোগ্য খরচ হ্রাস
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার আসলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার থেকেও খরচ কমিয়ে দিতে সক্ষম ভবিষ্যতে। আর এ কারণেই, পূর্বে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দিকগুলো খোঁজা হতো, তার বদলে বর্তমানে প্রতিটি সাধারণ কাজের ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহারের সম্ভাবনাকে নতুন করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু গবেষণা সাইন্স ফিকশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এআই ব্যবহার করে স্ক্রিপ্ট লেখা, ভাবানুবাদ তৈরি, নতুন আইডিয়ে তৈরি, প্রমোশন, কবিতা লেখা বা গল্প লেখার কাজও করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কৃষি, চিকিৎসা, ভারী যন্ত্র অ্যাসাম্বল বা যন্ত্রাংশ তৈরি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয় জয়কার।
গেমিং : ক্লাউড তারপর মেটাভার্স
নতুন গেমস অ্যাক্টিভিশন বিøজার্ডের ওপর মাইক্রোসফটের সাহসী ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এই খাতে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কোটি নকাটি ব্যবহারকারীর ডিজিটাল জীবনে তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা বজায় রাখতে চায় এমন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য গেমিং একটি মূল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে। ২০২১ সালে, ভাজর্চুয়াল গেম এবং প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে যা প্রাক-কোভিড গেøাবাল বক্স অফিস বা স্ট্রিমিং ভিডিওকে তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে। পনেরো বছর আগে, বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন গেমার ছিল এবং আজ প্রায় ২.৭ বিলিয়নের বেশি।
ভিডিও গেমের জগৎকে আরও এককাঠি উপরে তুলে ধরেছে মাইক্রোসফটের সিইও, সত্য নাদেলা। তার মতে, ‘মেটাভার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর বিকাশে মূল ভূমিকা পালন করবে গেমস।’ টেনসেন্ট, বাইটড্যান্সার ও টিকটকসহ বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলোর নেতৃত্বে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মেটাভার্স : পরবর্তী অনলাইনে সবার ঠিকানা
সহজ করে বললে, মেটাভার্স হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (ভিআর) ২০২২ সংস্করণ। এটি এমন একটি বিশ্ব, যা সফটওয়্যার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রথম নজরে একটি কল্পনাবিলাস হিসেবে বাতিল করার যোগ্য বিষয় বলে মনে হলেও এর সফলতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত রয়েছে।
বাড়ছে সাইবার হামলা ঝুঁকিতে গ্রাহকের তথ্য
সারা বিশ্বেই সরকারি-বেসরকারি গ্রাহক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সার্ভারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহৎ ক্লাউড সার্ভারে সাইবার হামলা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ফেসবুকের সার্ভারে হামলা চালিয়ে প্রায় ৫ কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বহুমাত্রিক নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা সার্ভারগুলোতে রক্ষিত তথ্যের (ডাটা) সুরক্ষাব্যবস্থা বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডিজিটাল নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থ্যালেস সিকিউরিটি জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এক বছর সময়ে বিশ্বজুড়ে বড় সার্ভারগুলোতে সফল হামলা ও তথ্য চুরির হার ১০ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএ টেকনোলজিস বলেছে, বিভিন্ন সার্ভার থেকে ব্যবহারকারীর তথ্য চুরির নেপথ্যে এসব তথ্যকে ঘিরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের যোগসূত্র রয়েছে। এতে বলা হয়, ‘বর্তমানে গ্রাহক তথ্য বাণিজ্য’ নতুন একটি ব্যবসার ধরন হিসেবে নীরবেই বিস্তৃত হচ্ছে। তবে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এজিএন ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ব্যয় বরাদ্দ ক্রমাগত বাড়াতে হচ্ছে। এর বিপরীতে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ বাণিজ্য চাঙ্গা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক খাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যাটিসটা’। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ম্যাগাজিন ফোর্বসের নিবন্ধে বলা হয়েছে, কঠোর আইন নয়, হামলা প্রতিরোধে ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধিই ‘ডিজিটাল ডাটা নিরাপত্তার’ মূল চাবিকাঠি।
যে কারণে ঝুঁকি বাড়ছে : থ্যালেস সিকিউরিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্লাউড সার্ভারগুলোতে হামলা ও তথ্য চুরির অনুপাত ছিল ১০০:২৬। অর্থাৎ, প্রতি ১০০টি হামলার ক্ষেত্রে গড়ে ২৬টি হামলায় হামলাকারীরা তথ্য চুরিতে সফল হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে এসে সাইবার হামলাকারীদের আক্রমণে সফলতার হার ১০ শতাংশ বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ, এ বছর প্রতি ১০০ হামলার মধ্যে গড়ে ৩৬টি হামলায় সফল হচ্ছে হামলাকারীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে প্রতি সেকেন্ডেই বাণিজ্যিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, গবেষণা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভারে হামলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও জার্মানির বিভিন্ন বাণিজ্যিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ও সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে হামলা হয় সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ১০ হাজার পর্যন্ত হামলার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। তবে দৃঢ় ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে বেশিরভাগ হামলাই ব্যর্থ হয়। তবে গত এক বছরে হামলাকারীরা সুদৃঢ় ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে সফল হচ্ছে, এমনটাই প্রমাণ মিলেছে। অর্থাৎ, হামলাকারীরা আগের চেয়ে অনেকে বেশি প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপর গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএ টেকনোলজিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিকভিত্তিতে গ্রাহকসেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানের ক্লাউড সার্ভার থেকে গ্রাহক তথ্য চুরির ঘটনা বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন অপারেটর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স সেবাদান প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকিং সেবাদান প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষিত থাকে। সেই গ্রাহক তথ্যকে ঘিরেই নতুন বাণিজ্য বিস্তৃৃত হচ্ছে এবং এই বাণিজ্যের প্রয়োজনেই ক্লাউড সার্ভারে সংগঠিত ও সফল হামলা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সিএ টেকনোলজিস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে তার কাক্সিক্ষত গ্রাহকের কাছে পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেওয়ার জন্যই বিপুল মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য আছে এমন সার্ভার থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহকসেবা দেওয়া অপারেটর কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো গোপনে গ্রাহকদের তথ্য বিক্রি করে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক এবং লিংকড ইনের বিরুদ্ধে আরও আগে থেকেই গ্রাহক তথ্য বিক্রি বা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে সফল হামলার ঘটনাও সবচেয়ে বেশি। দু-একটি হামলার ঘটনা স্বীকার করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ হামলার ঘটনা গোপন রাখে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক