দক্ষ জনবল তৈরিতে আরো প্রচেষ্টা প্রয়োজন

হীরেন পণ্ডিত: দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর কথা বলতে গেলে বেশকিছু দেশের নাম সামনে চলে আসে। এর মধ্যে আছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং আরো অনেক দেশের নাম। কেন এ দেশগুলো এত উন্নত তা একটু ভাবলেই সবার আগে তাদের প্রযুক্তির কথাই মনে পড়বে। জাপানের বিশেষজ্ঞদের উন্নতমানের গবেষণা তাদের প্রযুক্তিতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাদের উন্নতির কারণ খুঁজলে প্রথম সামনে চলে আসবে দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা। ১৯৫৮ সাল থেকেই জাপানে নিম্ন মাধ্যমিক লেভেলেই প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রযুক্তি শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়। নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শেখা এবং বাস্তবিক অর্থেই আধুনিক মেশিন তৈরি এবং চালনা করার মাধ্যমে জীবন এবং প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বোঝা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করা যাতে দৈনন্দিন জীবনের মান বৃদ্ধি পায়। শুধু স্কুলে নয়, অভিজ্ঞ শিক্ষক গড়তে তিন বছর মেয়াদি প্রযুক্তি শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এমনকি তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একজন পাঠক্রম বিশেষজ্ঞকে যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করে প্রযুক্তি শিক্ষার বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে। পরবর্তী সময়ে বৃত্তিমূলক কোর্সের সঙ্গে সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকাÐের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে শিল্প খাতে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার করতে পারেন। ১৯৮০ সালে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা কোর্সের প্রচলন করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও কারিগরি শিক্ষায় জোর দেয়া হয়েছে। এভাবেই দিনের পর দিন জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার লাভ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু পুঁথিগত জ্ঞান নয়, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়েছে। তারাই প্রযুক্তির উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখছে। জাপান যে প্রযুক্তিতে এত উন্নতি লাভ করেছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। জাপানের মতো বাংলাদেশও মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর বৃত্তিমূলক কোর্সের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, থাকতে হবে বাস্তবিক প্রয়োগ। এসব কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে সহজেই প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন, এজন্য যথেষ্ট বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। যে বিষয়েই ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেয়া হোক না কেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে যেন এসব কোর্সের মাধ্যমে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাস করার পরই কোনো চাকরি পেতে পারেন বা নিজের আয়ের উৎস নিজেই তৈরি করতে পারেন।
দেশের প্রধান শিল্প খাতগুলোয় দক্ষ জনবল ঘাটতি ক্রমে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। উৎপাদনে এর প্রভাব পড়ছে। ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। এ সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। অন্যদিকে বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী জনশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এ বিপুল মানুষের মাধ্যমে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা, তা আসছে না। এর অন্যতম কারণ প্রবাসে বাংলাদেশী দক্ষ জনশক্তির অভাব। দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। আবার দক্ষ কাজের লোক পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ পর্যায়ে এসে এমন দুষ্টচক্র উন্নয়নের গতিকে স্তিমিত করছে, যা এক ধরনের ফাঁদ। এখান থেকে পরিত্রাণে দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিকল্প নেই। সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই এটি অর্জন সম্ভব।
শিল্প বিকাশের জন্য যেমন নতুন শিল্প-কারখানা সৃষ্টির প্রয়োজন, তেমনিভাবে এসব কারখানায় দক্ষতা ও মুনাফা বৃদ্ধি করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি একান্তভাবে অপরিহার্য। দেশের কল-কারখানায়, শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানে, কৃষি খামারে, কৃষিজমিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও অধিক উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে দক্ষ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ কারণে বিদেশে দক্ষ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ জনশক্তি রফতানির তাগিদ দেয়া হচ্ছে। আধুনিক যুগে জাতীয় উন্নয়নের প্রশ্নে উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকতে পারে না। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উচ্চ পর্যায়ে দক্ষ লোকের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিআইডিএসের গবেষণায় উঠে এসেছে, কোথাও অষ্টম শ্রেণী পাস কর্মীর দরকার হলে দরখাস্ত আসছে মাস্টার্স পাসের। আবার কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দরকার হলে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে কর্মক্ষমতা কম। এক্ষেত্রে সবার ওপরের অবস্থানে সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে চতুর্থ। অর্থাৎ কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের পরে। এছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, মঙ্গোলিয়াসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের উপরে অবস্থান করছে। দক্ষতা উন্নয়ন এখন দেশের অন্যতম নীতি প্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এজন্য সরকারিভাবে বাড়ানো হচ্ছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও বড় মাত্রায় যুক্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিতে বিশ্ব অনেক এগিয়ে গিয়েছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। শ্রমের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অন্যতম চালিকাশক্তি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা। কিন্তু কারখানার সঙ্গে প্রয়োজনীয় বা সংগতিপূর্ণ শ্রমিক গড়ে উঠছে না। আবার দেশের প্রচলিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কারখানায় কাজ করতে পারছে না। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। গোটা বিশ্বে চলছে নবশিল্প বিপ্লবের উৎসব। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে না পারলে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে যেন বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুন করে সাজাতে হবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *